chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

চট্টগ্রামে হিজড়াদের ‘চল্লায়’ অতিষ্ঠ নগরবাসী

চট্টগ্রামে লিঙ্গ কেটে হিজড়া হয়েছেন ৫০ জন !

 চট্টগ্রাম নগরীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে হিজড়ার দল। নগরে দেড় হাজার হিজড়া চল্লায় (তাদের ভাষায় চাঁদাবাজিতে) লিপ্ত। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ব্যবসায়ী ও নগরবাসীরা। এসব হিজড়া নানা ছুঁতোয় অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বাসাবাড়িতে দলবেঁধে এসে জোর করে টাকা আদায় করছে। এছাড়াও তারা মাদক কারবার, পতিতাবৃত্তিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। পুলিশের চোখের সামনেই চলে তাদের চাঁদাবাজি। কিছু বললে সোজা থানা ঘেরাও। ফলে পুলিশও তাদের অত্যাচারকে ভয় পায়। তবে, হিজড়াদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের কর্মকর্তারা বলছেন, অবহেলা, বঞ্চনা এবং নানা সমস্যায় ভোগা হিজড়াগুলো বাঁচার তাগিদে হিংস্র হয়ে উঠছে।

হঠাৎ বাসার গেটে হৈচৈ। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েটি দরজা খুলে দিল। হুড়হুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল সালোয়ার-কামিজ এবং শাড়ি পরা সাত-আটজন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা ওই মেয়েটির কাছে টাকা দাবি করল। তাও অল্প নয় ৫ হাজার টাকা। মেয়েটির চিৎকার শুনে তার মা এগিয়ে আসেন। টাকা দিতে না চাইলে তাদের ব্যাপক গালাগালি। একপর্যায়ে দুই হাজার টাকা এবং একটি নতুন শাড়িতে রফা-দফা। কোতোয়ালি থানার জামালখানের লিচু বাগান এলাকায় একটি বাড়িতে এভাবেই মহাবিপদ থেকে রক্ষা পান মা-মেয়ে। চট্টগ্রামে এ চাঁদাবাজদের নাম হিজড়া।

কয়েক ঘটনা
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে নগরের বহদ্দরহাট মোড়ে দল বেধে চাঁদা তুলতে গিয়ে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে হিজড়ারা। এসময় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী আহত হন। সংঘর্ষ চলাকালে রাস্তায় যানবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যানজট লাগে। এর আগে জুবলী রোড়ে একটি বাণিজ্যিক অফিসে হামলা চালিয়েছে হিজড়ারা। চাঁদা না পেয়ে হিজড়াদের একটি দল এ হামলা চালায়। ওই অফিসের পিয়ন মনিরুজ্জামান জানান, ৮-১০ জন হিজড়া এসে দুই হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। তাদের দাবিকৃত চাঁদা না দেয়ায় জোরপূর্বক অফিসে ঢুকে স্টাফদের ওপর হামলা করে। গত জুলাই মাসে চট্টগ্রাম রেল ষ্টেশনে প্রবেশ করে হিজড়ার দল বেপরোয়া চাঁদাবাজি করে। এসময় বেশ কয়েকজনকে মারধর করে।
নগরীর ষোলশহর এলাকার ব্যবসায়ী শাহেদ মুন্সি বলেন, গত ১৯ আগষ্ট দুপুর ১২টার সময় আমি খুলশী এলাকায় একটি ডেভেলাপার কোম্পানির অফিসে অবস্থান করছিলাম। সে সময় ৭/৮ জনের একটি হিজড়ার দল উক্ত অফিসে ঢুকে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। অফিসের একজন কর্মকর্তা পাঁচশত টাকা দিতে চাইলে তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। এসময় সবাই মিলে তালি বাজাতে থাকে। এতে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে তাঁরা এক হাজার টাকা চাঁদা দিতে চাইলে হিজড়াদের পক্ষ থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। অফিস কর্তৃপক্ষ তা দিতে না চাইলে দুই জন হিজড়া কাপড়-চোপড় খুলে রীতিমত ন্যাংটা হয়ে অফিসের ভিতরে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। তারা কর্মকর্তাদের গায়ে খামচি মারার জন্য তেড়ে যেতে থাকে। অফিসের মহিলা কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হয়। এই অবস্থার অবশেষে দেড় হাজার টাকা দিয়ে কোন রকমে পার পাওয়া যায়।

হিজড়া ও তাদের আয় :
তাদের স্বপ্রণীত আইন অনুযায়ী ছেলে সন্তান হলে পাঁচ হাজার টাকা, মেয়ে সন্তানের জন্য ৩ হাজার টাকা ও বিয়ের জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার, অন্যান্য অনুষ্ঠানে আরও কয়েক হাজার টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া দোকানে দোকানে দলবেঁধে গিয়ে তারা চাঁদাবাজি করে। চাঁদার টাকা না দিলেই গালাগাল করে। টাকা না পেয়ে দোকানের মালামাল নিয়ে যায় তারা। চট্টগ্রামে হিজড়ারা ৮টি জোনে বিভক্ত ৭ জন গুরু মা এর অধীনে কাজ করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর হিজড়ারা অনেকটা বেপরোয়া। তারা সাপ্তাহিক চাঁদা দোকান প্রতি ১০/২০ টাকা হতে ৫০ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করে তুলে থাকেন। তারা দল বেধে প্রতিটি দোকানপাট ও অফিস আদালতে ব্যাপক চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো ৮/১০ জনের একটি দল অফিসে ঢুকে ২/৩ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দিলে যা করছে তা রীতিমত সন্ত্রাস।

যেভাবে বানানো হচ্ছে হিজড়া
ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি বেসরকারি ক্লিনিকে পেশাদার ও ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের দিয়েই পুরুষ লিঙ্গ কেটে হিজড়া তৈরি করা হয়। এসব ক্লিনিক যেন এক একটি হিজড়া তৈরির কারখানা। হিজড়া নামের আঁড়ালে লিঙ্গ কেটে পুরুষরা চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, খুন-খারাবিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। চাঁদাবাজির টাকায় গড়ে তুলেছে বাড়ি-গাড়ি। অঢেল সম্পদ। পুরুষ লিঙ্গ কেটে হিজড়ায় পরিণত করার বিষয়টি লিঙ্গ কর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সার্জিক্যাল চিকিৎসকরাও স্বীকার করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সার্জিক্যাল ক্লিনিকে পুরুষ লিঙ্গ কেটে বিশেষ বিশেষ ওষুধ সেবনের মধ্য দিয়ে তাদের লিঙ্গ কেটে এবং শারীরিক অবয়বে পরিবর্তন আনা হয়। লিঙ্গ কর্তনকারী হিজড়াদের মধ্যে খোদ চট্টগ্রামে রয়েছে প্রায় ৫০ জন। হিজড়ার এ তালিকায় থাকা অনেকের স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজন থাকলেও সহজ পথে, অল্প সময়ে এবং নিরাপদে টাকা আয়ের জন্য এ পথ বেছে নিয়েছেন একটি চক্র।

চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি এনজিও হিজড়াদের নিয়ে কাজ করে। তাদের মতে হিজড়াদের এ চাঁদাবাজিকে তারা ‘চল্লা’ হিসাবে অভিহিত করেন।
চট্টগ্রামে হিজড়াদের নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন বন্ধু সাংবাদিক ফেলো (গবেষক) ওমর ফারুক। তিনি বলেন,‘মূলত হিজড়াদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা ঠিক নয়। কিছু হিজড়া চাঁদাবাজি করলেও অধিকাংশ চল্লার টাকায় জীবন নির্বাহ করে। তাদেরও পেট আছে। তাদের খেতে হয়, পরতে হয়, চলতে হয়। কিন্তু কেউ তাদের কাজ করার সুযোগ দেয় না। অনেকটা বাধ্য হয়ে তারা ভিক্ষাবৃত্তি (চল্লা) করে জীবন চালায়।

নচ/চখ

এই বিভাগের আরও খবর