chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

কারাগারে থাকা বন্দীদের মৃত্যু বাড়ছে, উদ্বেগে স্বজনরা

মেহেদী হাসান কামরুলঃ সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় কয়েদি ও হাজতির মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। গত ২ মাসে কারাবন্দী অবস্থায় মারা গেছেন ৬ জন। এদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের নেতাও রয়েছেন। কারাগারের ভাষ্যমতে এসব বন্দীরা হঠাৎ করেই কারা অভ্যন্তরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তাদের প্রথমে কারা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়।

যদিও এসব মৃত্যৃ নিয়ে স্বজনদের বিস্তর অভিযোগ। এছাড়া কারাগারের ভেতরে বন্দীদের নির্যাতনের অভিযোগও নতুন নয়। প্রায় সময় বন্দী আসামিদের শারীরিক নির্যাতন করে খবরের শিরোনাম হয়েছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার। প্রতিকার চেয়ে স্বজনরা আদালতে মামলা পর্যন্ত করেছেন। হঠাৎ করে উদ্বেগজনক হারে কারাবন্দী মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন তদন্ত কমিটি গঠন করে নি কারা কর্তৃপক্ষ।

দুই মাসে যারা মারা গেলেন:

গত বুধবার (২ ফ্রেব্রুয়ারি) মো. হায়দার আলী নামে (৩৫) নামে ৫ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত এক কয়েদির মৃত্যু হয়। তার বন্দী নম্বর ১৩৬৮। চর পাথারঘাটা এলাকার ফকির আলীর ছেলে হায়দার আলী মাদক মামলায় রবিবার( ২৩ জানুয়ারি) কারাগারে যান। কারাগারে যাওয়ার ৮ দিনের মাথায় সে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের ১৬ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। ২ দিন চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান।

এর মাত্র ১০ দিন পর শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি ) বির্ভূতিভূষণ ভৌমিক নামে আরেক হাজতি মারা যান। তার হাজতি আসামি নম্বর ২১৪৩৮/২১।

গত মঙ্গলবার ( ২৯ মার্চ) মো. শাহজাহান (৪৩) নামে এক যুবদল নেতা মারা যান। বায়েজিদ থানার উত্তর কুলগাঁও এলাকার আব্দুল মালেকের ছেলে শাহজাহান ২০২১ সালের মঙ্গলবার (১৯ অক্টোবর) মাদক মামলায় কারাগারে যান। কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দুপুরে চট্টগ্রামে মেডিকেলে আনা হয়। ওইদিনই সন্ধ্যায় তিনি মারা যান।

এই ঘটনায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহজাহানের চাচাতো ভাই চট্টলার খবরকে বলেন, ‘আমার ভাই সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো কারাগারে যান। উনার কোন শারীরিক জটিলতা ছিলো না। ৫ মাসের মাথায় ভাইয়ের লাশ পেলাম। মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার ভাই কারাগারে অসুস্থ হয়েছে। আমরা তো দেখিনি। কাদের দায়ী করবো। তবে ভাইয়ের লাশ আনার পর দেখলাম হাত, মুখমন্ডল ফুলে গেছে। তাকে দেখে স্বাভাবিক মনে হয় নি। আমার ভাই বিএনপির রাজনীতি করতো।’

এই ঘটনার মাত্র দুই দিন পর মো. নুরুল আবছার (৪২) নামের এক বন্দী হাজতির মৃত্যু হয়েছে। লোহাগাড়া উপজেলার আহাম্মদ হোসেনের বাড়ির আহমদ হোসেনের ছেলে নুরুল আবছার ২০২১ সালের বৃহস্পতিবার ( ১০ জুন) কারাগারে আসেন। তার হাজতি বন্দী নম্বর-৯৪৩১/২১। পিতা-মাতা’র ভরণপোষণ আইনে বন্দী নুরুল আবছার কারাবন্দী ছিলেন। ২২ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। দুই দিন পর তিনি আবার অসুস্থবোধ করলে তাকে প্রথমে কারা হাসপাতাল পরে চমেক হাসপাতালে আনা হলে সেখানে তিনি মারা যান।

সবশেষ সোমবার (৪ এপ্রিল) এক দিনে রফিক উদ্দিন (৫৪) ও বাবুল মিয়া (৩৪) নামে দুই বন্দী হাজতির মৃত্যু হয়েছে। তারা দুজনই চন্দনাইশ থানার বাসিন্দা। এদের মধ্যে রফিক উদ্দিন মারামারি সংক্রান্ত একটি মামলায় কারাগারে যান। তার হাজতি বন্দী নম্বর-৫৫৬৭/২২। অন্যদিকে বাবুল মিয়া মাদক আইনে কারাগারে যান। তার হাজতি বন্দী নম্বর-১৯২৮৩/২১।

কারাগারে বন্দী নির্যাতনের অভিযোগঃ

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী নির্যাতনের অভিযোগ বহু পুরনো। প্রায় সময় বন্দীদের নির্যাতনের অভিযোগ তুলেন স্বজনরা। নির্যাতনে দিশেহারা হয়ে স্বজনেরা নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু আইনে মামলাও করেন।

মো. শামীম নামে সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে কারা হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ এনে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর আদালতে মামলা করেন শামীমের স্ত্রী পারভিন আক্তার হীরা। হীরার দায়ের করা মামলায় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম, জেলার দেওয়ান তারিকুল ইসলাম, কারারক্ষী আইজি প্রিজনের গোয়েন্দা সবুজ দাশ ও কারাগারের সুবেদার মো. এমদাদ হোসেনকে আসামি করা হয়।

মামলার আর্জিতে বাদী উল্লেখ করেন, তার স্বামী শামীম ২০০৪ সাল হতে কারাগারে বন্দী। বন্দী থাকা অবস্থায় সরকারি বিধি মোতাবেক তাকে খাবার দেওয়া হতো না। খাবারের বিষয়ে শামীম কারাগারের সুবেদার এমদাদের কাছে জানতে চাইলে এমদাদ বিষয়টি জেলারকে বলে দেন। পরে জেলার এসে তাকে মারধর করেন।

অপর আরেকটি ঘটনার বর্ণনায় বাদী উল্লেখ করেন, তুচ্ছ ঘটনায় তার স্বামীকে ডেপুটি জেলার সাইমুর, সুবেদার এমদাদ, সবুজ দাশ মারধর করেন। পরে তাকে জেলারের দেওয়ান তারিকুল ইসলামের রুমে নেওয়া হলে তিনি (জেলার) বলেন যে, ‘শালা এখনও মরে নাই, মরিলে এক কলম লিখিয়া দিব, কিছু হবে না’। দুটি ঘটনার পর বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে শামীমকে কুমিল্লা কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই সংক্রান্ত মামলার নথিপত্র চট্টলার খবরের কাছে সংরক্ষিত আছে।

এদিকে কারাগারে বন্দী মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার দেওয়ান তরিকুল ইসলাম চট্টলার খবরকে বলেন, হঠাৎ করেই বন্দী মৃত্যুর বিষয়টি আমাদেরও ভাবাচ্ছে। আমার কর্ম জীবনে প্রথম দেখলাম এক দিনে দুইজন কারাবন্দী মারা যেতে। আগে এমনটা হয় নি। চিকিৎসকের পরামর্শে যদি কারা বন্দীদের রুটিন চেকআপের আওতায় আনতে হয় আমরা সেই ব্যবস্থাও করবো।

বন্দীদের রুটিন চেকআপ করার পরার্মশঃ

কারাগারে বন্দীদের রুটিন চেকআপের পরামর্শ দিয়েছেন কারাবন্দী ও চিকিৎসক। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা কারাবন্দী ও আগে জেলে গেছেন এমন তিনজনের সাথে কথা বলেছে চট্টলার খবর।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বন্দী জানান কারাগারে বিভিন্ন বয়সের লোকজন বন্দী থাকেন। তাঁদের একেক জনের শারীরিক অবস্থা একেক রকম। বন্দীদের মধ্যে যারা বয়োবৃদ্ধ তাদের অধিকাংশের হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগ রয়েছে। তাছাড়া প্রতিনিয়ত বন্দীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমাদের নিয়মিত শারীরিক চেকআপ করা হয় না। কেউ যদি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন তাকে কারা হাসপাতালে নেওয়া হয়। ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়। এক্ষেত্রে আগে থেকে রুটিন চেকআপ করা হলে বন্দীদের জন্য ভালো হবে।

মোবারক হোসেন নামে কারাভোগ করে আসা এক ব্যক্তি বলেন জমি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মারামারির ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় আমি ১ মাস ২৩ দিন কারাভোগ করেছিলাম। কারাগারের যে হাসপাতাল রয়েছে তা বন্দী থাকা কয়েদি, হাজতির চিকিৎসা দিতে সম্পূর্ণ সক্ষম না। মানসম্মত চিকিৎসাও নেই। সামান্য কিছু হলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। বন্দীদের চিকিৎসার প্রতি কর্তৃপক্ষ উদাসীন। বয়োবৃদ্ধদের চিকিৎসায় যদি কারা কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী না হন যথাযথ চিকিৎসার অভাবে বন্দীরা মারা যাবে।

গ্যাস্ট্রোলিভার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ ইশরাত জাহান তামান্না বলেন, মানুষের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। সেই সাথে রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়তে থাকে। কারাগারে যেহেতু বিভিন্ন বয়সের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অবস্থান সেহেতু তাদের চিকিৎসার বিষয়টা ভাবতে হবে। সাধারণত চল্লিশোর্ধ্ব বয়স হলে মানুষের হৃদরোগের ঝুঁকি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি জটিলতাসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। এসব জটিলতা দেখা দিলে আগে থেকে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতে হয়। এক্ষেত্রে একজন বন্দীর রুটিন চেকআপ অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে নজর দিতে পারেন।

নচ/চখ

এই বিভাগের আরও খবর