chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

চট্টগ্রামে লাফিয়ে বাড়ছে ডায়রিয়া, রাস্তার পাশের লেবুর শরবতে কলেরার জীবাণু শনাক্ত

চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এ নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রামের কয়েকজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। আক্রান্তদের অনেকের মধ্যে ‘ভিব্রিও কলেরি’ অর্থাৎ কলেরার জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে বলেও জানিয়েছেন চিটাগাং মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার শামীম আহসান।

তবে ঠিক এ কারণেই যে ডায়রিয়ার রোগী বেড়েছে বলে মনে করছেন না চিকিৎসকেরা। কারণ তীব্র তাপপ্রবাহে বিশুদ্ধ পানি বা খাবার গ্রহণ না করা হলেও ডায়রিয়ার সমস্যা হতে পারে।

চট্টগ্রামে ডায়রিয়ার এমন প্রাদুর্ভাবের কারণ জানতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) একটি দল এখন চট্টগ্রামে অবস্থান করছে। উপজেলাগুলো পরিদর্শন ও বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার পরে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিবে তারা। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া পরেই ডায়রিয়ার মূল কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে মন্তব্য করেছেন আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরিন।

চারটি উপজেলার রোগী বেশি

জানা গেছে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই আসছেন শহরের বাইরে থেকে।

ব্রিগেডিয়ার শামীম আহসান জানান, প্রতি মাসে গড়ে ২০০ রোগী ভর্তি হতো। এপ্রিলের শেষের দিকে রোগীর সংখ্যা কিছুটা বেড়ে যায়। কিন্তু মে মাসে আরো বেড়েছে। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ৩৬০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে।

ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশই শিশু বলে জানান তিনি।

এছাড়াও সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী আনোয়ারা, বোয়ালখালি, বাঁশখালি, পটিয়া এ চারটা উপজেলায় ডায়রিয়ার রোগী বেশি। কী কারণে বেশি তার কারণ অনুসন্ধান করছে বিশেষজ্ঞ দল।

তবে চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ড. ওয়াজেদ চৌধুরী ধারণা করছেন, নদীর লবণাক্ত পানি, অতিরিক্ত গরম আর খাবার- এ তিনটিই ডায়রিয়া রোগী বাড়ার মূল কারণ হতে পারে।

ডায়রিয়া পানিবাহিত রোগ। অতিরিক্ত গরমের সময় বিভিন্ন কারণে মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। চট্টগ্রামে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ার পর অনেকেই আশঙ্কা করছিল লবণাক্ত পানির কারণেই সেখানে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

চট্টগ্রামে ওয়াসার পানিসহ বিভিন্ন এলাকায় পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে বেশ কিছু দিন ধরেই। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, শুধু লবণাক্ত পানির জন্যই ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা এত বাড়ার কথা নয়।

ব্রিগেডিয়ার শামীম আহসান বলেছেন, ‘স্যালাইনিটির জন্য যেটা হয় সেটা হলো অসমোটিক ডায়রিয়া। এমন ডায়রিয়া হলে রোগী দুই-চারবার টয়লেটে যেতে পারে। এর চেয়ে ভয়াবহ কিছু হবে না। আর শুধুমাত্র গরমের জন্যই এমন ডায়রিয়া হওয়া কথা নয়।

চট্টগ্রামে যেসব এলাকা থেকে রোগী বেশি আসছে, সেখানে পানিতে সমস্যা রয়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

ব্রিগেডিয়ার শামীম আহসান বলেন, ‘তীব্র গরমে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় পানির সঙ্কট তৈরি হয়েছে, অনেকে হয়ত বিশুদ্ধ পানি গ্রহণ করতে পারছে না। এখানে কিছু উঁচু জায়গা আছে, যেখানে পানি টিউবওয়েল বা পাম্পগুলোতে আসছে না। ওই সব জায়গার মানুষ পুকুরের পানি বা অন্য কোনো জায়গার পানি ব্যবহার করছে, ফলে তাদের সমস্যা হচ্ছে।

কলেরার জীবাণু

চিকিৎসকরা বলছেন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের অনেকের নমুনা পরীক্ষা করে তারা কলেরার জীবাণু পেয়েছেন।

চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ড. মামুনুর রশিদ জানান, তার হাসপাতালে সম্প্রতি ডায়রিয়ার রোগীর পাশাপাশি কলেরার রোগীও বাড়ছে।

ড. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘যাদের ডায়রিয়া হয় তাদের অনেকের লক্ষণ দেখে আমরা ভিব্রিও কলেরির পরীক্ষা করে থাকি। এখন যারা ডায়রিয়ার রোগী আসছেন, তাদের অনেকের মধ্যে কলেরার জীবাণু পাচ্ছি আমরা। সারাবছরই আমরা ডায়রিয়ার রোগীর চিকিৎসা করি। কিন্তু এখন ওর সংখ্যা বেড়ে গেছে। কলেরার জীবাণু মিলছে ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ রোগীর দেহে।’

তিনি বলেন, তার হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছেন কর্মজীবী অর্থাৎ যারা কাজের জন্য বাইরে বের হচ্ছেন তারা ডায়রিয়া বা কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে।

তিনি মনে করছেন, প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে এসব কর্মজীবী মানুষ বাইরে যে পানি বা খাবার গ্রহণ করছেন সেগুলো হয়ত বিশুদ্ধ নয়।

রাস্তার খাবার, লেবুর শরবত- ডায়রিয়ার জীবাণুগুলোর অন্যতম উৎস।

ড. রশিদ মনে করছেন, প্রাপ্তবয়স্ক যারা ঘরের বাইরে যাচ্ছেন তারা হয়ত এক সাথে এসব খাচ্ছে এবং রোগটি ছড়াচ্ছে।

কলেরার লক্ষণ
চিকিৎসকরা বলছেন, কলেরার জন্য দায়ী একটি বিশেষ ব্যাকটেরিয়া এবং ওই ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনটাই কলেরা।

কলেরার জীবাণুতে আক্রান্ত হলে শরীরে ডায়রিয়ার দেখা দেয় ও রোগী ক্রমাগত বমি করতে পারে। এছাড়া শরীরেও নানা লক্ষ্মণ দেখা দেয়। বিশেষ করে রোগী বারবার বমি ও মলত্যাগ করতে থাকে।

এছাড়া রোগী পানির তৃষ্ণা বেড়ে যেতে পারে। আবার দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়া কিংবা হার্টবিট বেড়ে যেতে পারে অনেকের। আবার অনেক রোগীর রক্তচাপও কমে যেতে দেখা যায়। আর কারো অবস্থা জটিল হয়ে গেলে কিডনি ফেইলিউর হলে, শকে চলে গেলে বা প্রস্রাব কমে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা গেলে মাইক্রো বায়োলজিক্যাল পরীক্ষার দরকার হয়।

সচেতন থাকা জরুরি

ডায়রিয়ার জীবাণু ছড়ানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম হচ্ছে পানি। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যে ডায়রিয়া হয় তার মধ্যে প্রধান কারণ কলেরা এবং ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া। এগুলো ছড়ানোর মাধ্যমই হচ্ছে এসব জীবাণু দ্বারা দূষিত পানি ও পঁচা-বাসি খাবার।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য অনুযায়ী, ডায়রিয়ার একটি ফর্ম হলো কলেরা, যার জীবাণু সাধারণত অপরিচ্ছন্ন খাবার বা দূষিত পানি থেকে আসে।

ডায়রিয়া প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি হচ্ছে খাবার প্রস্তুত করা, স্পর্শ করা, পরিবেশন করা ও খাবার খাওয়ার আগে টয়লেট থেকে বের হয়ে বা বাইরে থেকে ফিরে এসে হাত ধুয়ে নেয়া। কারণ হাত দিয়েই মানুষ সবকিছু স্পর্শ করে এবং সবচেয়ে বেশি জীবাণু বহন করে।

২৪ ঘণ্টায় তিন বা তার বেশি বার পাতলা পায়খানা হলে সেটিকে সাধারণত ডায়রিয়া বলা হয়। শুরুর দিকে বমি হয়ে থাকে। এছাড়া থাকে পেট কামড়ানো- এগুলো ডায়রিয়ার মূল লক্ষণ। এমন হলে সাবধান হতে হবে।

ড. মামুনুর রশিদ বলেন, কলেরা হলে চিকিৎসকরা বলেন রাইস ওয়াটার স্টুল। অর্থাৎ চাল-ধোয়া পানির মতো দেখতে পাতলা পায়খানা হবে প্রচুর পরিমাণে।

তিনি জানান, ‘রোগী বারবার বাথরুমে যাবে। অনেকের ২০ থেকে ২৫ বারও বাথরুমে যাবার অভিজ্ঞতা হতে পারে। অনেক সময় অনেক রোগীর আর শক্তি থাকে না বাথরুমে আসা-যাওয়ার মতো। কলেরায় খুবই দ্রুত শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে রোগী দ্রুত নিস্তেজ হয়ে যাবে এবং শকে চলে যাবে। তাই কলেরার বেলায় হাসপাতালে নিতে কোনভাবেই দেরি করা যাবে না।

চখ/জুইম

এই বিভাগের আরও খবর