chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে চলছে পাঁচ শতাধিক বাল্কহেড!

নৌপথে লাইটার জাহাজের বিকল্প হিসেবে পণ্য পরিবহণে বাল্কহেড ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল দিয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক বাল্কহেড চলাচল করে। বন্দর চ্যানেল কিংবা বহির্নোঙর এলাকায় বাল্কহেড চলাচল বিপজ্জনক। ফলে অবৈধ বাল্কহেডগুলো ঝুঁকিতে ফেলেছে বন্দর চ্যানেলকে।

তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বাল্কহেডকে লাইটারেজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ‘বাল্কহেড চলাচলে চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো অনুমোদন নেই। এক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বাল্কহেড কী

বাল্কহেড শব্দটি জাহাজনির্মাণের অভিধান থেকে এসেছে। জাহাজের মধ্যে জলরোধক বেষ্টনী/ বিভাজক বা পার্টিশনকে বাল্কহেড বলে। মূলত জাহাজের কাঠামোগত অনমনীয়তা বাড়ানোর জন্যই বাল্কহেড ব্যবস্থার উদ্ভাবন। তবে সেই নামে আমাদের নদীতে যেগুলো চলাচল করে, সেসব স্রেফ বালুসহ বিভিন্ন মালামাল বহনকারী ইঞ্জিনচালিত ট্রলার। নামের সঙ্গে চেহারা বা গড়নের কোনো মিল নেই।

বাল্কহেডের কর্মযজ্ঞ 

কোনো ধরনের অনুমোদন না থাকলেও বাল্কহেড নিয়মিত পণ্য খালাস করা হচ্ছে। বহির্নোঙরে বার্থিং নেয়া বড় বড় মাদার ভ্যাসেলগুলো থেকে এসব বাল্কহেড নিয়মিত পাথর, সার, কয়লা, ক্লিংকারসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য খালাস করে। বহির্নোঙরে মাদার ভ্যাসেল থেকে কয়লা কিংবা পাথর নিয়ে চলাচলকারী বাল্কহেডগুলো সমুদ্রপথেই নানা গন্তব্যে যাতায়াত করে। চট্টগ্রাম থেকে পাথর নিয়ে রাজবাড়ী, মীরসরাই, কুতুবদিয়া, মহেশখালীর মাতারবাড়ি, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন গন্তব্যে নিয়মিত চলাচল করছে বাল্কহেড। বন্দর চ্যানেল ধরে কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট, জুট র‌্যালি, গ্যাস র‌্যালি ঘাটেও পাথর খালাস করছে। মহেশখালী পাওয়ার হাব ও কুতুবদিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের উন্নয়ন কাজের নির্মাণসামগ্রী বহন কাজেও প্রচুর বাল্কহেড জড়িত। এছাড়া বহির্নোঙর এবং বন্দর চ্যানেলে বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্য নিয়ে বাল্কহেডগুলো স্থানীয়ভাবেও চলাচল করে। বাল্ক পণ্য লাইটারিংয়ের কাজেও এসব বাল্কহেড ব্যবহার করছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। বর্তমানে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১ হাজার বাল্কহেড রয়েছে। এসব বাল্কহেড দিনরাতে আউটার (বহির্নোঙর) থেকে পণ্য খালাস নিচ্ছে। দিনে কর্ণফুলী নদীতেই নোঙর অবস্থায় থাকে অসংখ্য বাল্কহেড। বন্দর কর্তৃপক্ষ মাঝে মধ্যে সামান্য জরিমানা করে তাদের দায় সারেন।

রাতে ম্যানেজ করে চলে বাল্কহেড

নৌ খাতের মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর নামক দুটি সংস্থা ছাড়াও নৌ-পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করেই প্রভাবশালীদের মাধ্যমে চলছে অবৈধ এসব নৌযান।

ঝুঁকিপূর্ণ যান বাল্কহেড 

বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কোনো ধরনের কারিগরি নকশা ছাড়াই মিস্ত্রি ও ওয়েল্ডারের পরিকল্পনায় এসব বাল্কহেড নির্মাণ করা হচ্ছে। যারা এ নৌযান তৈরির সঙ্গে জড়িত তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নেই। নির্মাণকারী ডকইয়ার্ডগুলোরও কোনো বৈধ অনুমতির কাগজপত্র নেই। এমনকি এসব নৌযানের কোনো হুইল থাকে না। বাল্কহেডে কোনো প্রশিক্ষিত জনবল নেই। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থানকারী বিভিন্ন মাদার ভ্যাসেল থেকে অসংখ্য বাল্কহেডকে পণ্যবোঝাই করতে দেখা গেছে। অনেকগুলো বাল্কহেড প্রায় ডুবতে ডুবতে বহির্নোঙর থেকে উপকূলের দিকে আসতেও দেখা গেছে। বাল্কহেডগুলো এমনভাবে তৈরি যে পণ্যবোঝাই অবস্থায় প্রায় পুরোটাই ডুবে থাকে। সামান্য দূর থেকেও দেখা যায় না। এতে জাহাজ চলাচলের সময় দুর্ঘটনা ঘটে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বাল্কহেড ডুবির ঘটনা ঘটছে। বছরে গড়ে ১৫টির মতো বাল্কহেড ডুবির ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘বাল্কহেড চলাচলে চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো অনুমোদন নেই। এসব এগুলো যে কোনো সময় দুর্ঘটনায় পড়লে আমাদের (বন্দর) চ্যানেলের জন্য ক্ষতি। এ ধরনের দুর্ঘটনা যদি চ্যানেলের মধ্যখানে হয় সেক্ষেত্রে বন্দরের জাহাজ অপারেশন বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে।

এ বিষয়ে বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন,  অবৈধ বাল্কহেড চলাচল বন্দর চ্যানেলের জন্য বড় ঝুঁকি। এজন্য আমরা বন্দরের পক্ষ থেকে ডিজি শিপিংকে অনুরোধ করি এ ধরনের নৌযানের অনুমোদন না দেওয়ার জন্য।

ব্যবসায়ীরা যে কারণে

ঝুঁকছে বাল্কহেডে 

অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিবহন এজেন্টরা বাল্কহেড দিয়ে বহির্নোঙর থেকে মাদার ভেসেলের পণ্য কম ভাড়ায় ব্যবহার করেন। কারণ হিসেবে এক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী জানান, দেশের সব এলাকায় লাইটার জাহাজ যেতে পারে না। বাঁশখালী এস.আলম পাওয়ার প্লান্ট, মঘনামা শেখ হাসিনা সাব মেরিন, কক্সবাজার বিমান বন্দর, কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি, ভাসান চর, সন্দ্বীপ, গুপ্তছড়া, নোয়াখালী মুছাপুর, কক্সবাজার রাবার ড্যাম এবং মিরেরসরাই অর্থনৈতিক জোনসহ যেসব স্থানে বিভিন্ন মেঘা প্রকল্পের কাজ চলছে সেখানে অবাধে যেতে পারে বাল্কহেড। তাছাড়া, লাইটার জাহাজের তুলনায় বাল্কহেডের ভাড়া একেবারে কম। এ কারণে বাল্কহেডের প্রতি আমদানিকারকদের নির্ভরশীলতা বেশি।

বাল্কহেড ব্যবসায়ীরা যা বললেন 

বাল্কহেড ব্যবসায়ী এসোসিয়েশন অব চট্টগ্রাম সভাপতি মোহাম্মদ চান মিয়া চট্টলার খরবকে বলেন, চট্টগ্রামে প্রায় দেড় হাজার বাল্কহেড রয়েছে। দেশের যেসব অঞ্চলে লাইটার ভেসেলের মাধ্যমে সরাসরি মালামাল পাঠানো যায় না, সেখানে বাল্কহেডের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করা হলে খরচ পড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা টনপ্রতি। তারস্থলে একবার লাইটার তারপর বাল্কহেডের মাধ্যমে পরিবহণ করা হয় সে ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে ৬০০ থেকে ৭০০টাকা বাড়তি খরচ পড়ে। একটি মাদার ভ্যাসেল একদিন অলস বসে থাকা মানে ১০-১৫ হাজার ডলার বাড়তি খরচ। বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় শুধু নয়, মেরিটাইম ওয়ার্ল্ডে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হচ্ছে।

বাল্কহেড ব্যবসায়ী এসোসিয়েশন অব চট্টগ্রাম এর উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য নুরুন্নবী প্রকাশ নুরু ফকির বলেন, বাল্কহেড সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার (বে-ক্রসিং) উপযুক্ত নয় বলে মহলবিশেষের ষড়যন্ত্রের কারণে প্রশাসন নিষেজ্ঞা দেওয়ায় আমদানিকারকদের বিরাট আর্থিক ক্ষতিরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ বাল্কহেড

শিপ হ্যান্ডলিংয়ে জড়িত একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য লাইটারিংয়ের জন্য অবৈধ বাল্কহেড ব্যবহার করে আসছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে এসব বাল্কহেড ব্যবহার বন্ধে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও রোধ করতে পারেনি বাল্কহেডের ব্যবহার। সর্বশেষ ২০২১ সালের শুরুতে বেশ কয়েকটি বাল্কহেড দুর্ঘটনার পর সমালোচনা ওঠায় জাহাজ মালিক, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর, শিপিং এজেন্ট, ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) ও লাইটার জাহাজ ঠিকাদারদের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তর বৈঠক করে বাল্কহেড চলাচলে বন্ধে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও রহস্যজনক কারণে গত তিন বছরে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি সরকারি সংস্থাগুলোর।

  • ফখ|চখ
এই বিভাগের আরও খবর