chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

ছোট্ট বয়সেই নির্মমতার শিকার তারা

আয়াত, জেমি ও মিনহাজ,মাহি। চার জনেরই বয়স দুই থেকে সাত বছরের মধ্যে। এ বয়সেই কঠিন নির্মমতার শিকার হয়েছে চার শিশু। শেষমেশ দুজন মায়ের কোলে ফিরে গেলেও ব্যতিক্রম ঘটেছে আয়াত আর মাহির ক্ষেত্রে।

মূলত পরিবারের যথাযথ নজরদারি না থাকা ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির না থাকায় এমন বর্বরতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও- বলছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।

হত্যার পর ৬ টুকরো করে সাগরে

বাসার পাশের মসজিদে আরবি পড়তে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয় পাঁচ বছর বয়সী আয়াত। এরপর থেকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও মেলেনি তার সন্ধান। মেয়ের সন্ধান না পেয়ে থানায় জিডি করেন বাবা সোহেল রানা।

আয়াত নিখোঁজের ৯ দিনের মাথায় তার দাদার বাসার ভাড়াটিয়া আবির আলীকে আটক করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আটকের পর তাকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদে খুলে ঘটনার জট। পিবিআই’র কাছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিতে থাকেন আবির।

স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ায় সম্প্রতি নগরের ইপিজেড থানার আকমল আলী সড়কের পকেট বাজার এলাকায় আলাদা একটি বাসা ভাড়া নেন আবিরের মা। তবে আবিরের বাবা এখনো আয়াতের দাদার বাসায় ভাড়ায় থাকেন।

দীর্ঘদিন ধরে সেই বাসায় ভাড়ায় থাকায় আয়াতের পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল আবিরের। সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে আয়াতকে অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা করেন তিনি।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫ নভেম্বর বিকেলে আরবি পড়তে যাওয়ার সময় আয়াতকে কোলে নেন আবির। এরপর নিয়ে যান বাবার ভাড়া বাসায়। সেখানেই আয়াতকে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ ছয় টুকরো করে সাগরে ভাসিয়ে দেন।

সাগরে ভেসে যাওয়ায় আয়াতের লাশের খণ্ডিত অংশ উদ্ধার করা সম্ভব না হলেও আবিরের দেওয়া তথ্যে হত্যায় ব্যবহৃত বটি ও অ্যান্টি কাটার উদ্ধার করে পিবিআই। উদ্ধার করা হয় আয়াতের পা, জামা-জুতাও।

পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক মর্জিনা আক্তার জানান, আয়াতকে অপহরণ করে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা ছিল আবিরের। এ জন্য রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া একটি সিমও সংগ্রহে রেখেছিলেন তিনি। যেন নম্বরটি থেকে ফোন করে টাকা দাবি করতে পারেন। কিন্তু সিমটি সচল না থাকায় আর ফোন করতে পারেননি।

অল্প আলাপে ঘনিষ্ঠতা, ৩০ হাজারে হাতবদল

তিন বছর বয়সী জেমি। নানির সঙ্গে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামে এসে অপহরণের শিকার হয় শিশুটি। এ ঘটনায় মামলা হলে দু’মাস পর ফেনী থেকে জেমিকে উদ্ধার করে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় অপহরণকারী মো. জয়নাল আবেদীন ওরফে সুমনকে।

জানা যায়, ২২ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে লাকসাম থেকে ট্রেনে চট্টগ্রামে আসার পথে অপহরণকারীর সঙ্গে শিশু জেমির নানির পরিচয় হয়। অল্প আলাপে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠতা। ট্রেনে জেমি কান্না করতে থাকলে কোলে নেন অপহরণকারী সুমন। আরেক মেয়ে পোশাককর্মী বন্দর থানার কলসিদিঘীর পাড় এলাকার বাসায় যাচ্ছিলেন জেমির নানি। কৌশলে বিষয়টি জেনে নেন সুমন। এরপর তিনিও সেদিকে যাচ্ছেন জানিয়ে বিশ্বস্ততা অর্জন করেন।

দুপুর আড়াইটার দিকে ট্রেন থেকে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে নামেন তারা। এরপর বাসে চড়ে চলে যান ইপিজেড এলাকায়। তখনও সুমনের কোলে ছিল জেমি। বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে কলসিদিঘী রোডে ঢুকে সামনের দিকে হাঁটছিলেন জেমির নানি। তখনই সুমন জেমিকে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান। পরে এ ঘটনায় বন্দর থানায় মামলা করেন জেমির বাবা।

জেমি উদ্ধার ও অপহরণকারীকে গ্রেফতারের পর পুলিশ জানায়, মামলার পর ঘটনাস্থলসহ রেলস্টেশন, বাস স্টপেজ ও সম্ভাব্য স্থানে সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা করা হয়। একইসঙ্গে অপহরণকারীকে শনাক্তের পাশাপাশি কয়েক দফা কুমিল্লার লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চালানো হয় অভিযান। একপর্যায়ে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ২২ নভেম্বর মীরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ থানার বারৈয়ারহাট এলাকা থেকে অপহরণকারী সুমনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তার দেওয়া তথ্যে ফেনী সদরের একটি বাসা থেকে অপহৃত শিশু জেমিকে উদ্ধার করা হয়।

গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সুমন জানান, শিশু জেমিকে নিজের শ্যালিকার মেয়ে পরিচয় দিয়ে ১২ বছর ধরে নিঃসন্তান ফেনীর আমেনা আক্তার ওরফে খালেদার কাছে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে দত্তক দেন তিনি। পরে সুমনকে আদালতে পাঠানো হয়। এছাড়া আদালতের মাধ্যমে শিশুটিকে অভিভাবকের হেফাজতে দেওয়া হয়।

দেড় বছর পর মায়ের কোলে মিনহাজ

২৫ জুলাই চাকরির খোঁজে রাঙ্গুনিয়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসেন রুমা আক্তার। আসার সময় তার দুই বছর বয়সী সন্তান মিনহাজকে রেখে আসেন ভাইয়ের স্ত্রী শিরিন আক্তারের কাছে। আর সন্তানকে ভাইয়ের স্ত্রীর কাছে রাখাই যেন কাল হয় রুমার। মাত্র ৫০ হাজার টাকায় শিশু মিনহাজকে নিজের খালাতো বোনের কাছে বিক্রি করে দেন শিরিন। একপর্যায়ে রুমা বিষয়টি জানতে পারলেও উদ্ধার করতে পারছিলেন না সন্তানকে। শেষে আদালতের আদেশে ২৩ নভেম্বর বিক্রির এক বছর চার মাস পর মায়ের কোলে ফিরে যায় শিশু মিনহাজ।

মুক্তিপণ না পেয়ে ধর্ষণের পর হত্যা

মাহি মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ইউনিয়নের দক্ষিণ সাইরার ডেইল এলাকার আয়াত উল্লাহর মেয়ে ও দক্ষিণ সাইরার ডেইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। ৩০ নভেম্বর দুপুর ১২টার দিকে মাহি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর দুপুর ২টার দিকে খেলতে বের হয়। এ সময় বাড়িতে স্ত্রী না থাকার সুযোগে চকলেটের প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে ভাড়া বাসায় নিয়ে শিশুটিকে ধর্ষণ করে সোলাইমান। পরে মোবাইল ফোনে একাধিকবার ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে সোলাইমান।

এক পর্যায়ে মাহি অজ্ঞান হয়ে পড়লে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাগেজের ভেতর ঢুকিয়ে রাতের অন্ধকারে অটোরিকশায় করে পার্শ্ববর্তী পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের করিয়ারদিয়া এলাকায় লবণমাঠে ফেলে দেয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সমাজবিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে সম্প্রতি শিশুর প্রতি নির্মমতার কয়েকটি ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে। প্রতিটি ঘটনা মানবতার চূড়ান্ত লঙ্ঘন। শিশু আয়াতের কোনো দোষ না থাকার পরও তাকে হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করা হয়েছে। অপর দুই শিশুকে বিক্রি করে দিয়ে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পর শিশুরা মায়ের কোল ফিরে পেলেও তাদের ছোট্ট মনে এসব ঘটনা বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। যারা এমন জঘন্য অপরাধে জড়াচ্ছেন তাদের পরিবার এর দায় এড়াতে পারে না। অপরাধীরা ছোটবেলা থেকে পরিবারের যথাযথ পরিচর্যা পেলে হয়তো এমন ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে হতো না।