chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

কচি হাতে বাড়ছে সংসারের ভার!

নিজস্ব প্রতিবেদক: নগরের অলংকার মোড়ের বাসস্ট্যান্ড। যেখানে বাসের শ্রমিক আর যাত্রীদের হাঁকডাকে মুখর। দূর-দূরান্ত ছুটে চলা মানুষের ভিড় যেনো লেগেই থাকে। এই বাসস্ট্যান্ডে এলে দেখা মিলবে লিকলিকে শরীরের আট বছরের শিশু রহিমের। সকাল থেকে রাত অবধি ঘুরে ঘুরে পান আর সিগারেট বিক্রি করে সে। সারা দিনে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে তার অভাবের সংসার।

কথা বলতে গেলে রহিম জানায়, সে ক্লাস থ্রী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। মা অসুস্থ হওয়াতে এবং করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় সংসারের হাল ধরেছে। তবে এখন স্কুল খুললেও আর যাওয়া হবেনা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায়।

১২ বছরের সায়মন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রেলগেইট এলাকায় একটি ঝুপড়ি বাসায় তাদের বসবাস। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় পানির বোতল, বেলুন কিংবা ফুল বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে সে। দেড় বছর আগেও নিয়মিত স্কুলে যেত সে। ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে সংসারের হাল ধরে একমাত্র বোনের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে।

কচি হাতে বাড়ছে সংসারের ভার
মনের সুখে বিয়ারিংয়ের গাড়িতে চড়ে আনন্দে আত্বহারা এসব শিশুরা জানেনা অনিশ্চিত এক ভবিষ্যত অপেক্ষায় আছে তাদের। শিক্ষাহীন এসব পথশিশুরা আগামীতে ভুল পথে পা বাড়ালে এই দায় কী নিবে আমাদের সভ্য সমাজ? ছবিটি নগরীর সিআরবি এলাকা থেকে তোলা। আলোকচিত্রী – এম ফয়সাল এলাহী

সায়মন চট্টলার খবরকে বলেন, সকাল আটটায় বোনকে নিয়ে বের হয়েছি। মা অসুস্থ কাজ করতে পারে না। ছোট বোন স্থানীয় একটি প্রাইমারী স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। আব্বার টাকায় সংসার চলে না। বোনের পড়াশোনা আর মার ওষুধের টাকার যোগাড় করতে হয়। যা বিক্রি হয় মার হাতে তুলে দেই।তার বোন রুম্পা জানালো, পানির বোতল মাথায় নিয়ে ভাইকে হাঁটতে দেখে সহযোগিতা করতে বের হয়েছে।

নগরের আতুরার ডিপো এলাকায় ১২ বছরের শিশু জসিমের বাড়ি। তার বাবা মো. সেলিম ভিক্ষাবৃত্তি করেন। মা বিয়ের অনুষ্ঠানে মানুষের বাসায় রান্নার কাজ করে। বাবার আয়ে সংসার চলছিল না। তাই ছয় মাস আগে জসিমকে মুরাদপুরে একটি ওয়ার্কসপে কাজ দিয়ে যান তার বাবা। কেবল রহিম, সায়মন কিংবা জসিম নয় চট্টগ্রামে এ রকম বহু শিশু আছে যারা পেটের তাগিদে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে।

রেলস্টেশন, ওয়ার্কসপ, চায়ের দোকান, মালবাহি পরিবহন, ময়লার স্তুপে ঘুরে প্লাস্টিকের অব্যবহৃত জিনিস কুড়াতে দেখা যায় এসব শিশুদের। খোলা আকাশের নিচে রোদ বৃষ্টিতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় তাদের। অবহেলা আর অভাবে অনিশ্চিত জীবন-যাপন করতে বাধ্যে হচ্ছে।

নতুন বইয়ে আর পোশাকে স্কুলে বন্ধুদের সাথে খেলার বদলে তাদের কচি হাতে উঠেছে সংসারে ভার। অনেক সময় মাদক পাচার ও চুরির মতো বিপদজনক কাজেও জড়িয়ে যাচ্ছে এরা। ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করা হচ্ছে। আঁধারে নিমজ্জিত হচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ।

দেশের পথ শিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২ অক্টোবর দেশে পালিত হয় জাতীয় পথশিশু দিবস। জাতিসংঘ এবং এর অঙ্গ সংগঠন ‘ইউনিসেফ’শিশু অধিকার ও তাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা সংকটের কারণে নগরে দিন দিন পথশিশুর সংখ্যা বাড়ছেই। তবে এর সঠিক পরিসংখ্যান নিয়েও সরকারি ও বেসরকারিভাবে গড়মিল রয়েছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অপারেজয় বাংলার তথ্যমতে, ২০১১ সালে নগরে ৩৭ হাজার ৬০০ পথশিশু ছিল। এখন পর্যন্ত পথশিশুদের নিয়ে বিশ্বস্ত কোনা জরিপ চালানো হয়নি। ২০১৭ সালে নগরে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছে সাজেদা ফাউন্ডেশন। ঢাকার পর চট্টগ্রামে পথশিশুদের জন্য চালু রয়েছে সংস্থাটির কার্যক্রম। বর্তমানে সাজেদা ফাউন্ডেশনে ৫৭টি পথশিশু ডে-কেয়ার রয়েছে।

করোনাকালীন সংকটে পথশিশুদের দু বেলা করে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া পথশিশু মায়েদের হাতে এককালীন তিন হাজার টাকা অর্থ সহায়তা দেয়া হয়। করোনার কারণে সাজেদা ফাউন্ডেশন দিনটি ঘিরে কোনো অনুষ্ঠান হাতে নেয়নি।

সাজেদা ফাউন্ডেশনের অ্যাসিসটেন্ট কো-অডিনেটর মামুন উর রশিদ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত পথশিশুদের ঝড়ে পড়া রোধ এবং শিক্ষা নিশ্চিতে দুটি প্রক্রিয়ায় অনুসরণের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, অনানুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক দু ভাবে পথশিশুদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। ঝড়ে পড়া পথশিশুদের ক্ষেত্রে স্থর, বয়স অবস্থানের ওপর বিবেচনা করে কারিগরি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও জীবনমুখী শিক্ষার মাধ্যম যুক্ত করতে হবে। এর পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে।

আরকে/জেএইচ/চখ

এই বিভাগের আরও খবর