chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

ইয়াবার পথেই আসছে আইস,ছড়িয়ে পড়ছে দেশে

দেশে ইয়াবার চেয়ে ভয়ঙ্কর মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের বিস্তার বাড়ছে। দেশে বানের মতো ঢুকছে ভয়ংকর মাদক ক্রিস্টাল মেথ (আইস)। মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্ত পথে আসছে এ নেশাদ্রব্য। সাগর,পাহাড় ও সড়ক পথে আসা মাদকের চালান সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে আইস বা ক্রিস্টাল মেথ । রাজধানী ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতেও পৌঁছে গেছে ভয়ঙ্কর এই মাদক। উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা আসক্ত হয়ে পড়ছে এসব মাদকে। চাহিদার কারণে এ মাদকের পাচারও বাড়ছে। আর তাতে ধরাও পড়ছে একের পর এক চালান। সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট নগরের বন্দর থানার কলশী দিঘীর এলাকায় পাচঁলাইশ থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে মো.রফিক ও মো. তৈয়ব নামের দুইজনকে গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৫ হাজার ইয়াবার সঙ্গে ৪ গ্রাম আইসও উদ্ধার করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষ কোনও মাদক প্রতিরোধে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যস্ত থাকে, তখন অন্য মাদকের ওপর নজরদারি কিছুটা কমে। এই সুযোগে বিকল্প আরেকটি মাদক প্রবেশ করে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইয়াবায় এমফিটামিন থাকে পাঁচ ভাগ, আর আইসের পুরোটাই এমফিটামিন। ফলে এটি ইয়াবার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ক্ষতিকর এবং অনেক বেশি পরিমাণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে মানবদেহে। মানবদেহে অতি অল্প সময়ে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে এই মাদক। এটি সেবনে মস্তিষ্কের রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। ফলে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। আইস বা ক্রিস্টাল মেথে শতভাগ এমফিটামিন থাকায় এটি বিশ্বজুড়ে ভয়ঙ্কর মাদক হিসেবে চিহ্নিত।

জানা গেছে, ১৮৮৭ সালে জার্মানিতে মারাত্মক সব ড্রাগের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয় ক্রিস্টাল ড্রাগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধবিমানের চালক ও সৈনিকদের সারাক্ষণ নির্ঘুম রাখতে জার্মানি ও জাপানে মাদকটি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হতো। পরবর্তীতে এই মাদকের নাম পরিবর্তিত হয়ে কোথাও ক্রিস্টাল মেথ, আইস, এক্সটেসি এবং এলাকাভেদে নানা ছদ্মনামে এর ব্যবহার চালু হয়। ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিস্টাল মেথ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, লাওস, চীন, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে মাদকটির ব্যবহার শুরু হয়। ক্রিস্টাল আইস উচ্চমাত্রার একটি মাদক এবং এটি সেবনে অনিদ্রা ও অতি উত্তেজনা তৈরি হয়। মাদকটি ফলে স্মৃতিভ্রম ও মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি, লিভার নষ্ট হয়। এছাড়া দাঁতক্ষয়, অতিরিক্ত ঘাম, চুলকানি, রাগ ও আত্মহত্যার মতো ভয়ানক প্রবণতাও তৈরি হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, নগরের খুলশী থেকে চট্টগ্রামে প্রথম নতুন ধরনের মাদক আইসের প্রথম চালান ধরা পড়ে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন ১৪০ গ্রাম আইসসহ দুই জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৭। এরপর গত মে মাসে চন্দনাইশ উপজেলা থেকে ২০০ গ্রাম আইসসহ এক যুবককে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ২০২১ সালের ১৭ জুন কর্ণফুলী উপজেলা থেকে ৫ গ্রাম আইসসহ গ্রেফতার করা হয় আরও একজনকে। একই বছর ১২ জুলাই নগরের কোতোয়ালি থানার পাথরঘাটা নতুন ফিশারীঘাট এলাকা থেকে ৯৭৫ গ্রামের আইসের বড় চালান জব্দ ও তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়াও গত কয়েক বছরে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে একাধিকবার ক্রিস্টাল মেথসহ একাধিকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

২০১৯ সালের শেষের দিকে ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিয়মিত অভিযানে ৫ গ্রাম আইসসহ এক যুবককে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তখনই আইসের কথা জানা যায়। এরপর ওই যুবকের স্বীকারোক্তিতে ঝিগাতলার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় হাসিব বিন মোয়ামের রশিদ নামে এক ব্যক্তিকে। রশিদ ওই বাসার তলকুঠুরীতে ‘আইস’ তৈরির কারখানা বসিয়ে সবে উৎপাদন শুরু করেছিল বলে জানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। রশিদের কাছে ২৯ গ্রাম আইস পাওয়া গিয়েছিল। পরে রশিদের স্বীকারোক্তিতে বসুন্ধরা এলাকায় থেকে নাইজেরীয় এক নাগরিককে ৫০০ গ্রাম আইস সহ গ্রেফতার করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দিনে দিনে বাড়ছে আইস আসক্তের সংখ্যা। শুরুতে রাজধানী কেন্দ্রীক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের মধ্যে আইসের চাহিদা থাকলেও এখন এর চাহিদা সব শ্রেণির মাদকসেবীদের। ঢাকার মতো দেশের অন্যান্য মহানগরীতেও তৈরি হচ্ছে আইস সেবনকারী শ্রেণি। চাহিদার কারণে এ মাদকের পাচারও বাড়ছে। আর তাতে ধরাও পড়ছে একের পর এক চালান।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আইস অনেক দামি মাদক। ছোট ছোট মাদক কারবারিরা ইয়াবার পাশাপাশি বর্তমানে এর ব্যবসাও শুরু করেছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের টার্গেট করে মূলত মাদকটি ছড়িয়ে পড়ছে। ১ গ্রাম আইস অন্তত ৮ জন সেবন করতে পারে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সোমেন মন্ডল জানান, ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারীদের কেউ কেউ এখন ক্রিস্টাল মেথ পাচারের সাথে সম্পৃক্ত। আমরা তাদের চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। ক্রিস্টাল মেথের আন্তর্জাতিক এবং আভ্যন্তরিণ রুট চিহ্নিত করতে কাজ করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ক্রিমিনালাইজেশন অব পলিটিক্স এবং পলিটিসাইজেশন অব ক্রিমিনালদের মিথক্রিয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যরা আইস কারবারের সঙ্গে জড়িত। যার কারণে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি যথার্থ বাস্তবায়ন ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে আইস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্রের সংশ্লিষ্টরা বলেন, মাদকাসক্তদের চিকিৎসার পাশাপাশি পুর্নবাসনের জন্য যুব উন্নয়ন অধিদফতর এবং বিভিন্ন উন্নয়নসহযোগী সংস্থার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করতে হবে। মাদক বিক্রি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোকে চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও সদস্য বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মাদক সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

 

এই বিভাগের আরও খবর