chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

চট্টগ্রামে বৃহস্পতিবারের যানজটে নগরবাসীর শনির দশা

বহদ্দারহাট খাজা রোড থেকে নিয়িমত সাইকেলে লালখান বাজার আসেন জাফর সাদেক। তিনি বলেন, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, জিইসি মোড় ও ওয়াসা মোড়ের আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজট ছিল। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় আজ বৃহস্পতিবার তাঁর দ্বিগুণ সময় লেগেছে।

দুপুরে ষোলশহর এলাকাতেও ছিল তীব্র যানজট। সেখান থেকে আগ্রাবাদ মোড় পর্যন্ত মোটরসাইকেলে আসতে শাহেদ মুন্সির প্রায় ৪০ মিনিট সময় লেগেছে, অন্য সময় ১০ মিনিটের মতো লাগে। তিনি বলেন, আজকের যানজট ভয়াবহ ছিল।

আজ বৃহস্পতিবারের এ দুটি ঘটনা চট্টগ্রাম নগরের ব্যস্ততম এলাকাগুলোর। চট্টগ্রাম নগরে বৃহস্পতিবার আসলেই তীব্র যানজট লেগে যায়। বৃহস্পতিবারে শনির দশা লেগে যায় পথচারীদের। তীব্র যানজটে ত্রাহি অবস্থা হয় নগরবাসীর।

চট্টগ্রামে যানজট পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন নগরীর বিভিন্ন স্পটে যানজট লেগে থাকে। যানজটের কারণে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার। অপরিকল্পিত বাসস্ট্যান্ডের কারণে নগরীর চার প্রবেশমুখ কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। নগরীর অক্সিজেন মোড়, শাহ আমানত সেতু চত্বর, কাপ্তাই রাস্তার মাথা এবং সিটি গেট-কর্নেল হাটে যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। নগরীর বিমানবন্দর সড়কে যানজট পরিস্থিতি সবচেয়ে মারাত্মক। বিমান ধরার জন্য কয়েক ঘণ্টা আগে যাত্রা শুরু করেও যানজটের কারণে অনেকে ফ্লাইট মিস করেন। আমদানি-রপ্তানি পণ্যের কন্টেইনার পরিবহনে নিয়োজিত লরিগুলো (প্রাইমমুভার) প্রধান সড়কের দুই পাশে পার্কিং টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এ ছাড়া বন্দরের ভেতরে ঢোকার জন্য অপেক্ষমাণ ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের সারিও যানজটের অন্যতম কারণ। এ যানজটের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ে আগ্রাবাদ, বারেকবিল্ডিং মোড়, নিমতল, দেওয়ানহাট পর্যন্ত। একইভাবে হালিশহর ও পতেঙ্গা পর্যন্ত এ যানজট লেগে থাকে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের ‘চট্টগ্রাম মহানগরীতে যানজট ও তার বিরূপ প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৬টি কারণে চট্টগ্রাম নগরে যানজট হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাস্তার মোড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা, সড়কে বিভিন্ন গতির ও অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল করা, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, আইন প্রয়োগ ও কার্যকরের অভাব, অপর্যাপ্ত ও অপরিকল্পিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশের অভাব, সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়া, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক, রাস্তা ও ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়া।

গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট থেকে বারিক বিল্ডিং মোড়ের দূরত্ব ৭ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার। শহর এলাকায় যানবাহনের স্বাভাবিক গতি (ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার) অনুযায়ী, এই পথ পাড়ি দিতে সর্বোচ্চ ১২ মিনিট লাগার কথা। কিন্তু লাগছে ন্যূনতম ২৭ মিনিট। স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ সময় লাগার কারণ যানজট। একই কারণে শহরে গাড়ির গতি কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৭৫ কিলোমিটারে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রমজান মাস আসার আগ থেকেই নগরের বেশিরভাগ সড়কের দুই পাশের ফুটপাত দখল করে চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য। যত্রতত্র যানবাহন দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী উঠা-নামা করানোর কারণে প্রতিটি মোড়েই এক ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। নগরের অভ্যন্তরে দিনে ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ অন্যান্য মালবাহী যানবাহন চলাচল এবং অবৈধ পার্কিং-এর ফলে যানজট সৃষ্টির পাশাপাশি জনসাধারণের স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যানবাহন (যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক) চলাচলের ফলে সড়কে গাড়ির চাপ বেড়েছে। এসব সমস্যার সমাধান না হওয়ার পেছনে ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজিকে দায়ী করছেন অনেকেই।

চট্টগ্রাম নগরে সবচেয়ে বেশি যানজট লেগে থাকে চকবাজার এলাকায়। শুধু চকবাজর এলাকায় স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়সহ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে পড়তে আসেন শিক্ষার্থীরা। যাদের অনেকেই আবার ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন। বাইরে থেকে আসা অতিরিক্ত গাড়ির ফলে যানজট সৃষ্টি হয়।

এই এলাকাতেই বাস করেন ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, এভাবে এক এলাকায় এত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর কোথাও নেই। পরিকল্পিত নগরায়ণের এটি অন্তরায়। এই এলাকায় বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করতে দেওয়ায় এমন হয়েছে, ফলে যানজট বাড়ছে।

এদিকে, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নগরীতে দিনে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার উদ্যোগ নিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ। সিএমপি সূত্র জানায়, প্রতিদিন সকাল আটটা হতে রাত আটটা পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, লং-ভেহিকেল, প্রাইমমুভারসহ অন্যান্য পণ্য ও মালবাহী যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে। রাত আটটার পর পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল ও মালামাল ওঠা-নামা করানো যাবে। তবে জরুরি আমদানিকৃত খাদ্যদ্রব্য, পণ্য ও রপ্তানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য বিশেষ ব্যবস্থায় চলাচল করতে পারবে।

সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া চট্টলার খবরকে বলেন, যানজট নিরসনে নগরীতে বড় বাসের মতো গণপরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন পৃথক লেন। প্রয়োজনে ডাবল ডেকার প্রচলন করা যায়। এর ফলে ছোট যানবাহনের সংখ্যা কমে যাবে।

একাধিক নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি এক দিনে তৈরি হয়নি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, রাস্তার স্বল্পতা, ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধি, ফুটপাত ও রাস্তা দখল, গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয়হীনতা—এসব মিলে এই যানজট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও তাঁরা সন্দিহান।