chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

বাড়ি ভাড়ার ভোগান্তি কাটছে না

নগরীর বাকলিয়া এলাকায় দুই সন্তান নিয়ে একটি ছোট বাসায় ভাড়া থাকেন পোশাক শ্রমিক আসমা আক্তার। দুই রুমের জন্য তাঁকে ভাড়া দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। ছয় মাস যেতে না যেতেই বাড়ির মালিক তাঁকে নোটিশ দিয়েছেন সামনের জানুয়ারি মাস থেকে ১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দিতে হবে। অন্যথায় বাসা ছেড়ে দিতে বলেছেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এভাবে যদি বাসা ভাড়া বাড়তে থাকে তাহলে আমাদের না খেয়ে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

একই অভিযোগ নগরীর জামালখানের লিচু বাগান এলাকার শাহরিয়ার মাসুমের। তিনি এক লক্ষ টাকা জামানত দিয়ে চার রুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন চলতি বছরের শুরুতে। ভাড়া ২৩ হাজার টাকা। গত কয়েকদিন আগে ফ্ল্যাটের মালিক নোটিশ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে আগামী জানুয়ারি মাস থেকে ২৫ হাজার ভাড়া দিতে হবে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বাড়ির মালিক যদি বাড়িভাড়া নেয়ার সময় বলতেন ছয় মাস পর ভাড়া বাড়বে তাহলে আমি এ বাসা নিতাম না।

এভাবে নতুন বছর শুরুর আগেই বাড়িভাড়া বাড়ানোর নোটিশ পাচ্ছেন ভাড়াটিয়ারা।বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে ২৫ বছর আগে করা ত্রুটিপূর্ণ আইনের সুযোগে বাড়িওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারিতার যেন শেষ নেই। এ যেন এক পাগলা ঘোড়া! বাড়িভাড়া বাড়ানো নিয়ে বাড়িওয়ালাদের নৈরাজ্য ঠেকাতে ১৯৯১ সাল পরবর্তী কোনো সরকারই কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অথচ ২০১৭ সালের দিকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করে বাড়িভাড়া নিয়ে বিরোধের কারণ চিহ্নিত করতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেও তা এখনো উপেক্ষিত। ইতোমধ্যে ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।

বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া কল্যাণ সমিতি চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির প্রচার সম্পাদক সাংবাদিক ওমর ফারুক চট্টলার খবরকে বলেন, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ ও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ প্রণীত বিধিমালা ১৯৬৪-এ যথাযথ বাস্তবায়ন ও কার্যকর না হওয়ায় বিভাগীয় শহরে ভাড়াটিয়ারা অসহায় দিন কাটছে। গত ৩২ বছরে (১৯৯০-২০২২) চট্টগ্রাম শহরে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ২৫০ শতাংশ। লাগামহীন এ বাড়িভাড়ায় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে বাসা বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা অগ্রিমও নেয়া হয়। বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের সাথে বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত কোনো চুক্তি করেন না। দেন না ভাড়া নেয়ার ছাপানো রশিদও। বাসা ছেড়ে দিতে যে পরিমাণ সময় দেয়ার কথা, তা নোটিশের মাধ্যমে জানান না। সবই হয় মৌখিকভাবে অথবা সাদা কাগজের ফর্দের মাধ্যমে। আইনি ঝামেলায় পড়তে হতে পারে এ কারণে বাড়িওয়ালারা লিখিত কোনো কিছু করেন না। আবার কর ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যেও বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ রাখেন না বাড়িওয়ালারা।

বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া কল্যাণ সমিতির মহাসচিব সৈয়দ তৌকির আহমদ চট্টলার খবরকে বলেন, একদিকে লাগামহীন বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ও অন্যদিকে যখন তখন স্বল্প নোটিশে ভাড়াটিয়াদের বাড়িছাড়া করছে ভবন মালিকরা। রশিদের পরিবর্তে হাতে হাতে লেনদেন হওয়ায় এ নিয়ে আইনের আশ্রয়ও নেয়া যাচ্ছে না। গত ৩২ বছরে (১৯৯০ থেকে ২০২২) চট্টগ্রাম শহরে বাড়িভাড়া আড়াইশ শতাংশ বেড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, অতিরিক্ত ভাড়ার চাপে এই মানুষগুলোর জীবন বিপর্যস্ত।

একাধিক ভাড়াটিয়া অভিযোগ করে বলেন, বিভিন্ন অজুহাতে বছরে একাধিকবার ভাড়া বাড়ানো হয়। আর নতুন বছর উপলক্ষে এবারও ইচ্ছামাফিক বাড়িভাড়া বাড়িয়েছেন তারা। বর্ধিত এ ভাড়ার বিষয়ে ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে নোটিশ দেয়া হয়েছে। আবার মাঝে মধ্যে কোনো নোটিশ ছাড়াই পরের মাসে বাড়ি ছাড়তে বলা হয় ভাড়াটিয়াদের। এর অন্যতম প্রধান কারণ হল, বাড়ির মালিকরা যখন বাড়ির ভাড়া বাড়ান তখন যদি ওই ভাড়াটিয়া বর্ধিত ভাড়া মেনে না নেন তাহলে হঠাৎ করেই কোনো নোটিশ ছাড়াই তাঁকে বাড়ি ছাড়তে নির্দেশ দেন। এ অনিয়মতান্ত্রিক ভাড়াবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানালে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলছেন মালিকরা। ভাড়াটিয়ারা আরও জানান, বাড়ির মালিকরা বললেও বাড়ি ছাড়া যাচ্ছে না, কেননা ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজের সুবিধার্থে অভিভাবকরা সুবিধাজনক স্থানে বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। চট্টগ্রামে তীব্র আবাসন সংকটের মধ্যে নতুন করে বাসা খোঁজা যেমন বিড়ম্বনার তেমনি কষ্টসাধ্য।

ভাড়াটিয়া কল্যাণ সমিতির মহাসচিব সৈয়দ তৌকির আহমদ চট্টলার খবরকে বলেন, এমন পরিস্থিতিতে বাড়িভাড়া আইন ঢেলে সাজানোর জন্য কমিশন গঠন করে এলাকা ভেদে বাড়িভাড়া নির্ধারণ করা দরকার।

মানবাধিকার আইনজীবী নাসির উদ্দিন মহসিন চট্টলার খবরকে বলেন, বাড়িভাড়া নিয়ে নাম মাত্র যে আইন আছে সেটি বাস্তবায়িত হয় না। কোন মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করবে, সে ব্যাপারে আইনে কিছু বলা নেই। এটা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের করার কথা। আর সিটি করপোরেশনগুলো সব বাড়ির হোল্ডিং কর নির্ধারণ করে দেয়। কাজেই তাদের উচিত প্রতিটি বাড়ির ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া।

জানা গেছে, দেশে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে ১৯৯১ সালের একটি পুরোনো আইন আছে। আইনে বলা আছে, ভাড়াটিয়ার কাছে কোনো ধরনের জামানত বা কোনো টাকা দাবি করা যাবে না। অগ্রিম হিসেবে এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা নেয়া যাবে না। প্রতি মাসে ভাড়া পরিশোধের রসিদ দিতে হবে। কিন্তু আইনকানুনের ধার ধারেন না কেউ। ফলে লাগামহীন বাড়িভাড়ায় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত।

এই বিভাগের আরও খবর