chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

ছোট্ট পূর্ণিমা চাকমার অমাবস্যার গল্প

সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ,বিশেষ প্রতিনিধি:  কাপ্তাই থেকে ফিরে ১১/১২ বছরের ছোট্ট এক শিশু পঙ্গু মাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে বাসা থেকে বাজারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মায়ের হাতে কিছু সবজি। সকাল ১১টায় বেশ কিছু দূর পথপাড়ি দিয়ে মাকে বাজারে বসিয়ে দিয়ে বইপত্র নিয়ে স্কুলের দিকে যাওয়ার তাড়া তার। বিকালে স্কুল ছুটির পর মাকে বাজারে সময় দিয়ে  ক্লান্ত শরীরে হুইল চেয়ার টেনে বাসায় ফেরা তার। বাবা বেঁচে নেই। তাই পঙ্গু, অক্ষম মায়ের সামান্য আয়ে এক বেলা খেয়ে দু’বেলা না খেয়ে জীবন কাটে পুর্ণিমা চাকমার।

পূর্ণিমা চাকমা রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা পাহাড়িকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ট শ্রেণীর ছাত্রী।২০২০ সালের ১১ এপ্রিল তার বাবা জ্যোতিষ চাকমা মারা যান। ২০০৪ সালে পূর্ণিমার  মা স্বপ্না চাকমা কুষ্ঠরোগের কারণে দুই পা হারান।

যে বয়সে একজন মেয়ে বাবা মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাবার কথা, সে ছোট্ট তুলতুলে হাত হুইল চেয়ারের হাতল ধরে পঙ্গু  মাকে জীবন সংগ্রামে সহযোগিতা করেছে। যে বয়সে সহজে খাবার পাওয়ার কথা, সে বয়সে মায়ের সঙ্গে জীবনযুদ্ধে নামতে হচ্ছে পূর্ণিমাকে।

পূর্ণিমার মা স্বপ্না চাকমার জীবন পূর্ণিমার চেয়ে করুণ, বেদনার ও ট্রেজেডি পূর্ণ।

১৯৯৮ সালের মে মাসের কোন এক সময়, চন্দ্রঘোনা কুষ্ঠ হাসপাতালে কুষ্ঠ রোগ নিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলাধীন নোয়াপাড়া মাষ্টার দা সূর্য্যসেন পল্লীর স্বপ্না দাশ। এরই মধ্যে কুষ্ঠ হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে বিনাখরচে তার চিকিৎসা চলছে ভালোমতই। কিন্ত নিয়তির কি বিধান। কুষ্ঠ রোগের কারণে দুই পায়ে ক্ষত দেখা দেয়। চিকিৎসকের পরামর্শে ২০০৪ সালে স্বপ্নার দুই পা কেটে  ফেলা হয়। তবে এরই মধ্যে ভালোবেসে ফেলেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আর এক কুষ্ঠরোগী জ্যোতিষ চাকমাকে। ১৯৯৯ সালে রাউজানের স্বপ্না দাশ জ্যোতিষ চাকমাকে বিয়ে করে স্বপ্না চাকমা ধর্মাবলম্বী হয়ে যান।

স্বপ্না চাকমা জানান, চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টান ও কুষ্ঠ   হাসপাতালের পরিচালক ডা: প্রবীর খিয়াং  তাদেরকে কুষ্ঠ হাসপাতালের কোয়াটারে সম্পূর্ণ বিনা ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা করেন। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতার কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং ঔষধ দেন স্বামী-স্ত্রীকে। ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল মারা যান তাঁর স্বামী জ্যোতিষ চাকমা।  তিনি জানান, এরপর ছোট ছোট দুটি বাচ্চা নিয়ে পঙ্গু অবস্থায় কোন পথ দেখছি না। খেয়ে না খেয়ে দিনকাটে। তারপরও হাল ছাড়িনি।

স্বপ্না চাকমা বলেন, তার এক ছেলে আকাশ চাকমা ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে এখন বাসের হেলপারের কাজ করে।  একমাত্র  মেয়ে পূর্ণিমা চাকমা চন্দ্রঘোনা পাহাড়িকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ট শ্রেণীতে পড়ছে। অভাবের কারণে মেয়েকে ভালো কাপড়চোপড়,খাতা কলম কিনে দিতে পারিনা।

কাপ্তাই সড়কের লিচুবাগান বনগ্রাম মুল রাস্তার পাশে সবজি বিক্রি করতে আসা স্বপ্না চাকমা বলেন, কোন দিন ৫০০ কোনদিন ৩০০ আবার কোনদিন ২০০ টাকা বিক্রি হয় তার।  বাজারে এখন আশেপাশে অনেক অস্থায়ী দোকান বসার কারনে  আগের মতো বিক্রি নেই। এইভাবে খুব অর্থকষ্টে ২ ছেলেমেয়েদের নিয়ে জীবনের কারনে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি।

কান্না জড়িত কন্ঠে স্বপ্না বলেন, এই বয়সে একজন মেয়ে আনন্দ করবে, খেলাধুলা করবে, প্রাণবন্ত থাকবে। কিন্তু, মেয়ের সেই শখ আমি পূরণ করতে পারচ্ছিনা।

পূর্ণিমা চাকমা বলেন, আমি বনগ্রাম  জুম পাড়া চার্চে প্রতি রবিবার বিকেলে সঙ্গীতা ম্যাডামের কাছে নাচ শিখছি। গত মাসে কাপ্তাই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির একটা প্রোগামে আমি নাচ করেছি। কি আনন্দ লেগেছে।  এই নাচ শেখার পেছনে আমার কোন টাকা পয়সা লাগে না। সবকিছু ব্যবস্থা করে দেন আমাদের মিশন এলাকার অনুপ দাদু। আমিও চাই অন্যান্য বন্ধু বান্ধবদের মতো খেলতে, ঘুরতে।

পূর্ণিমা বলেন, আমি একদিন বড় হবো। বড় চাকরি করবো। মায়ের আর কষ্ট হবে না।