chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

ধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুত শেষ করে সাজা কার্যকর করতে হবে

শামীম হামিদ: দেশজুড়ে ব্যাপক আন্দোলন ও গণদাবির মুখে নারী ও শিশু ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করা হয়েছে। গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধনী), ২০২০ অনুমোদন দেওয়া হয়। আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এই অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, বর্তমানে সংসদের অধিবেশন না থাকায় এবং আইনটির কার্যকারিতা জরুরি হয়ে পড়ায় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করে তা কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। অধ্যাদেশ জারি হওয়া মাত্রই তা কার্যকর হয়েছে মর্মে গণ্য করা হবে।

ধর্ষণের অপরাধ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনের ৯(১) ধারায় উল্লেখ ছিল, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।

আইনের এই ধারায় সংশোধনী এনে বলা হয়েছে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ কথাগুলো প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। এছাড়া আইনের ৯(৪) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

এই ধারায় সংশোধনী এনে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ কথাগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া আইনের ২০ ধারায় চিলড্রেন অ্যাক্ট, ১৯৭৪-এর পরিবর্তে শিশু আইন, ২০১৩ প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

দেশে সাম্প্রতিকালে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ধর্ষণের পর মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। আর এই সময়ে ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৯২ জন নারী এবং ৯ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন।

তবে এসব তথ্য ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয় বলেই অনেকে মনে করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লোকলজ্জা কিংবা সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কায় ভুক্তভোগী নারী আইনের আশ্রয় নিতে চান না। ফলে অনেক অভিযোগ থানা পর্যন্ত পৌঁছায় না। অভিযোগ দিতে থানায় গিয়েও নারীদেরকে নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয়। পুলিশের কাছে ধর্ষিতাকে প্রমাণ করতে হয় তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় এই বিষয়টি নারীদের জন্য যথেষ্ট বিব্রতকর বলেই সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন।

ধর্ষণের অভিযোগ করে প্রতিকার না পাওয়া নারীর সংখ্যাও দেশে নেহায়েত কম নয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে ধর্ষণের ঘটনায় ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার থেকে মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৫৪১টি। এর মধ্যে আসামির শাস্তি হয়েছে মাত্র ৬০টি ঘটনায়।

ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন পরিবর্তন কতটা সুফল বয়ে আনবে তা নিয়ে সন্দিহান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। তিনি যাবজ্জীবনের পরিবর্তে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা যেন শুধু লোক দেখানো আইন না হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ধর্ষণের পুলিশী তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়ায় নারীর প্রতি সহনশীল হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেছেন, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা বা রাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে অনেক সময় ধর্ষক পার পেয়ে যায়। এমন বাস্তবতায় মৃত্যুদণ্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি কোনো লাভ বয়ে আনবে কি না সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অবশ্য আশাবাদী, ধর্ষণের সাজা যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদণ্ড করায় এই ধরনের অপরাধ কমে আসবে। ধর্ষণের পুরাতন মামলাগুলো আগে এবং নতুন মামলাগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

সমাজকর্মীরা মনে করেন, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ আন্তরিক হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব। এর জন্য সংশ্লিষ্ট বিচারকগণকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর পাশাপাশি আইন মন্ত্রণালয় থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপিদেরকে নির্দেশনা প্রদান করতে হবে, যাতে তারা ধর্ষণ মামলাগুলো শেষ করার ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেন। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। এই সময়সীমার মধ্যেই মামলার বিচার শেষ করার উদ্যোগ নিতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

মনে রাখতে হবে শুধুমাত্র কঠোর আইন দিয়েই ধর্ষণের মত অপরাধ রাতারাতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। এবিষয়ে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ধর্ষণের মত পৈশাচিক অপরাধ দমনে কঠোর আইনের যেমন প্রয়োজন রয়েছে আবার আইনের যাতে অপপ্রয়োগ না হয় তাও মাথায় রাখতে হবে।

এক্ষেত্রে ২০০৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ওই আইনে দায়ের মামলার ৮০ ভাগেরই কোনো বাস্তব ভিত্তি পাওয়া যায় না। এই আইনে ৯০ দিনের মধ্যে দ্রুত বিচার করতে হয়। ফলে দেখা যায়, বিবাদীপক্ষকে ভুয়া মামলা দিয়ে চাপের মুখে ফেলে প্রতিপক্ষ টাকাকড়ি নিয়ে আপস-নিষ্পত্তি করে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই আইনে ২০১৮ সালের ১৫ হাজার মামলার অভিযোগের ৪ হাজারটির কোনোই সত্যতা মেলেনি। ২০১৭ সালে মাত্র সাড়ে ৭০০-র মতো মামলার বিচার হয়েছে। জামিন-অযোগ্য অপরাধ বিধায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বা প্রতিশোধ নিতে অনেক নারীকে এসব মিথ্যা মামলায় বাদি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

নারী নির্যাতন (নিবর্তক শাস্তি) অধ্যাদেশ, ১৯৮৩, এবং ১৯৯৫ ও ২০০০ সালের আইনেও শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ছিল। কিন্তু বিচার সম্পন্নের হার ছিল মাত্র সাড়ে তিন শতাংশ। শাস্তির হার ছিল শতকরা এক ভাগের নিচে। তাই কঠোর আইন প্রণয়নই শেষ কথা নয়। আসল কথা আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করা। বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর সাজা কার্যকর করাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে মহামান্য রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমার সুযোগ নিয়ে অপরাধী যাতে পার পেয়ে না যায় সেদিকে সবিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।

এমআই/চখ

এই বিভাগের আরও খবর