chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

আবদুর করিম সাহিত্যবিশারদের ৬৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলা সাহিত্যের অমর পুঁথিগবেষক মুন্সি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের আজ (বৃহস্পতিবার) ৬৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী। এদিন সাহিত্যবিশারদ স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকালে সাহিত্যবিশারদ স্মৃতি সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁর কবরে পুষ্পমাল্য অর্পন করাসহ সাহিত্যবিশারদ স্মৃতি সংসদ প্রাঙ্গনে খতমে কোরআন ও মিলাদ মাহফিলসহ স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। মৃত্যুবার্ষিকীতে সাহিত্যবিশারদ স্মৃতি সংসদ প্রতিবারের ন্যায় এবছরও ব্যাপক কর্মসূচী’র আয়োজন করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সাহিত্যবিশারদ স্মৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ছৈয়দ চেয়ারম্যান ।

বাংলা পুঁথি সাহিত্যের দিকপাল পুরুষটি ১৮৭১ সালে মতান্তরে ১৮৬৯ সালের ১১ অক্টোবর পটিয়ার ঐতিহ্যবাহী সুচক্রদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুনশী নুরউদ্দীন। তার মাতা মিস্রীজান প্রখ্যাত পাঠান তরফদার দৌলত হামজা বংশের মেয়ে ছিলেন। জন্মের কয়েক মাস আগে পিতার মৃত্যু এবং ১৭ বছর বয়সে মাতৃহীন আবদুল করিম দাদা-দাদি ও চাচা-চাচির স্নেহছায়ায় এন্ট্রান্স পাস করেন এবং নিজ প্রচেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।

তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়েছিল নিজ বাড়ির দেউরিতে। সেখানেই তিনি আরবি-ফারসি ও বাংলায় পড়া শুরু করেন। অতঃপর তিনি সুচক্রদন্ডী মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এক বছর পড়াশোনা করে তিনি পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৮৯৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

উল্লেখ্য যে, এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তার দ্বিতীয় ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং সঙ্গত কারণেই উনিশ শতকে এন্ট্রান্স পাস করতে ইংরেজি ভাষাজ্ঞানেও পারদর্শী হতে হতো। চট্টগ্রাম কলেজে দু’বছর এফএ পড়ার পর ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক সম্পন্ন পরিবারের মতো তাদের পরিবারেও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা দেখা দেয়। এর সঙ্গে যোগ হয় শারীরিক অসুস্থতা। পরীক্ষার আগে তিনি টাইফয়েড এ আক্রান্ত হন। ফলে তার আর এফএ পরীক্ষা দেয়া হয়নি। এখানেই তার উচ্চ শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বাল্যকাল থেকেই পুঁথিপত্রের প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলেন। সারাজীবন তার নেশা ছিল দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাক্ষিক-মাসিক ইত্যাদি পত্রিকা পাঠ করা এবং সংগ্রহ করা। তিনি তাঁর বাড়িতে তাঁর পিতামহ কর্তৃক সংগৃহীত কিছু পুঁথির সঙ্গে পরিচিত হন। এই পুঁথিগুলো পড়ে তিনি পুঁথি সংগ্রহ ও লিখতে আগ্রহী হন। এ পুঁথিগুলোর মধ্যেই পেয়ে যান ‘চন্ডীদাসের পদাবলী’। সেসময় তিনি ছিলেন এফএ ক্লাসের ছাত্র। এ সময় তিনি আচার্য অক্ষয় সরকার সম্পাদিত ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় ‘প্রাচীন পদাবলী’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধ পাঠ করেই মহাকবি নবীন চন্দ্রসেন সাহিত্যবিশারদের প্রতি আকৃষ্ট হন।

তিনি ১৮৯৫ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলের শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবনের শুরু করেন। পরবর্তীকালে সীতাকুণ্ড মধ্য ইংরেজি স্কুলের অস্থায়ী প্রধান শিক্ষক হন। চট্টগ্রামে প্রথম সাব-জজ আদালতে অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে কাজ করেন। পরে কবি নবীন সেনের সুপারিশে চট্টগ্রাম কমিশনার অফিসে যোগদান করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এমন একজন ব্যক্তি, যিনি আজীবন প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সেবা করে গেছেন। বাঙালি লেখকেরা যখন পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাবে ও অনুরাগে আধুনিক বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তখন প্রাচীন ও মধ্যযুগের পুঁথি সংগ্রহ, পুঁথির রক্ষণাবেক্ষণ এবং পুঁথি সম্পাদনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।

মূলত পুঁথি সংগ্রহ, পুঁথির রক্ষণাবেক্ষণ ও পুঁথি সম্পাদন ছিল তার জীবনের ব্রত। বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রধান উপাদান পুঁথি পত্র ও এদেশের প্রাচীন ও মধ্য যুগের লৌকজ-সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন।

তাঁর সম্পাদিত নরোত্তম ঠাকুরের ‘রাধিকার মানভঙ্গ’, ‘সত্যনারায়ণের পুথিঁ’, দ্বিজ রতিদেবের ‘মৃগলুব্ধ’ রামরাজার ‘মৃগলুব্ধ সম্বাদ’, দ্বিজ মাধবের ‘গঙ্গামঙ্গল’, আলী রাজার ‘জ্ঞানসাগর’, বাসুদেব ঘোষের ‘শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস’, মুক্তারাম সেনের ‘সারদামঙ্গল’, শেখ ফয়জুল্লাহর ‘গোরক্ষবিজয়’ ও আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ (খণ্ডাংশ) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত। ‘ইসলামাবাদ’ (চট্টগ্রামের সচিত্র ইতিহাস) ও ‘আরাকান রাজসভায় বাঙ্গলা সাহিত্য’ (মুহম্মদ এনামুল হকের সহযোগে রচিত) তাঁর দুটি মৌলিক গ্রন্থ।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ উনিশ-বিশ শতকের রেনেসাঁর মানসপুত্রদের একজন। তার সময়ে খাঁটি বাঙালির সংখ্যা কমই ছিল। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তাঁর সময়ে উপমহাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িক চেতনায় কণ্টকিত হয়েছিল। কিন্তু আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে ওই পঙ্কিল স্রোত কলুষিত করতে পারেনি। আবদুল করিমের এই নিরলস সাহিত্য-সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯০৯ সালে ‘সাহিত্য বিশারদ’ উপাধি এবং ১৯২০ সালে নদীয়ার সাহিত্য সভার কাছ থেকে ‘সাহিত্য সাগর’ উপাধি লাভ করেন।

চট্টগ্রাম পৌরসভা তার স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে চট্টগ্রামের লাভ লেইন সড়কটির নাম পরিবর্তন করে আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ সড়ক নামকরণ করেছে এবং দেরীতে হলেও সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান করেন। বাংলা সাহিত্যের এই অতুলনীয় সাহিত্যকর্মী ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের নিজ বাসভবনে ‘চট্টগ্রামের অজানা কাহিনী’ লিখতে বসে রাত ১০টা ৪৭ মিনিটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

এসএএস/জেএইচ/চখ

এই বিভাগের আরও খবর