chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

ইতালিতে নিয়মিত বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়েছে

ইউরোপের দেশ ইতালিতে বাংলাদেশিদের আসা শুরু হয় ৯০-এর দশকে। কিন্তু এটি তীব্র হয় ২০০০-এর দশকে। ইউরোপের বাইরের দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশিরা এখন ইতালিতে অষ্টম সর্বোচ্চ।

চলতি বছরের জুলাইয়ে ইতালির শ্রম ও সামাজিক পরিকল্পনা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী ইতালিতে নিয়মিতভাবে বসবাস করছেন এক লাখ ৫০ হাজার ৬৫২ জন বাংলাদেশি অভিবাসী। ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এটি সর্বোচ্চ।

ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান দিয়ে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশিরা থাকেন ফ্রান্সে এবং তৃতীয় প্রধান দেশ স্পেন।

তবে ইউরোপ মহাদেশে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি বাস করেন যুক্তরাজ্যে। ব্রেক্সিটের পর দেশটি আর ইইউর অংশ না হওয়ায় ইতালিতে এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান বাংলাদেশি কমিউনিটির বসবাস।

২০০২ সালে ইতালিতে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল ২২ হাজার। অর্থাৎ ২০ বছরে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সাত গুণ। ইতালিতে বসবাসরত বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে নিজ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ইতালি থেকে যেসব দেশে অভিবাসী রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ইতালি থেকে পাঠানো মোট রেমিট্যান্সের ১৫ শতাংশ যায় বাংলাদেশে।

রাজনীতি, অর্থনীতি ও জলবায়ু

বাংলাদেশিরা যেসব প্রাসঙ্গিক কারণে ইতালিতে স্থায়ী হচ্ছেন সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা, নাজুক অর্থনীতি ও জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রধান হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ইতালি কর্তৃপক্ষ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী কারণে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি থেকে নাগরিকদের দেশ ছাড়ার হার বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ৪৪ লাখেরও বেশি মানুষ জলাবয়ু পরিবর্তনের কারণে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত হয়ে তাদের ঘর বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় শীর্ষ দেশ। টানা বন্যা বাংলাদেশের প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম। অপরদিকে, বিশ্বের অনেক দেশের মতোই করোনা মহামারি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে।

২০২০ সালে এসে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কমেছে, কমেছে রপ্তানি আয়। বিপরীতে, বেড়েছে বৈষম্য এবং দারিদ্র্যের হার, যা ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪১ শতাংশ হয়েছে।

৯০-এর দশকে ইতালিতে আসা বাংলাদেশি অভিবাসীরা মূলত দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত ছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, এক দল উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষ তরুণ এবং একক পুরুষ অভিবাসী। তারা নিজেদের সামাজিক মর্যাদা ও উন্নত জীবনের খোঁজে ইতালিতে আসতে শুরু করেন।

অপর ভাগে ছিলেন, অদক্ষ একক পুরুষ অভিবাসীরা, যারা কোনো একটি কাজের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে দেশে থাকা নিজেদের পরিবারের খরচ যোগান দেওয়ার লক্ষ্যে ইতালিতে আসতে শুরু করেন।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আসা বাংলাদেশিদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এসব ব্যক্তি প্রায়শই আন্তর্জাতিক সুরক্ষা ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে থাকেন। মূলত লিবিয়ায় ‘সেকেন্ডারি মাইগ্রেশন’ বা অস্থায়ী কর্মী হিসেবে আসা তরুণ বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক দাসত্বের শর্ত থেকে মুক্তি পেতে ভূমধ্যসাগরের পথ বেছে নেন।

নারী ও পুরুষ অভিবাসীদের সংখ্যায় অসমতা

ইতালিতে অবস্থানরত নিয়মিত বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে পুরুষ ও নারী অভিবাসীদের সংখ্যা মধ্যে বড় ধরনের লিঙ্গ অসমতা উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশিদের মধ্যে ৭১.৭ শতাংশ অভিবাসী একক পুরুষ হিসেবে ইতালিতে বসবাস করেন। আর নারীদের সংখ্যা ২৮.৩ শতাংশ। লিঙ্গ অসমতার দিক দিয়ে ইতালির ইইউর বাইরের দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ও সেনেগালের পর বাংলাদেশের অবস্থান।

মূলত বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনের শুরুতে পরিবারগুলো মূলত কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীদের ওপর বিনিয়োগ করে থাকেন। ফলে মোট বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে তরুণদের প্রধান্য বেশি। এছাড়া অভিবাসীরা নিয়মিত হওয়ার পর তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আসার সুযোগ পান। সেটাও এই বৈষম্য তৈরির অন্যতম একটি কারণ।

ইতালিতে বাংলাদেশি পুরুষদের মধ্যে ৫৭.৩ শতাংশের বয়স ৩৫ বছর বা তার নিচে। ইউরোপের বাইরের দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের তুলনায় বাংলাদেশি তরুণ অভিবাসীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

অপরদিকে বাংলাদেশি নারীদের মধ্যেও তরুণীদের সংখ্যা বেশি। মোট নারীদের মধ্যে ৩৫.৭ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক। ইউরোপের বাইরের দেশগুলো থেকে আসা মোট নারী অভিবাসীদের মধ্যে এই গড় ২০.৩ শতাংশ।

২০২২ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ইতালিতে বাংলাদেশি অপ্রাবয়স্ক অভিবাসী বা ১৮ বছরের কম বয়সি অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার। যা ইউরোপীয় দেশগুলোর বাইরে থেকে আসা মোট অপ্রাপ্তবয়স্কের ৪.৫ শতাংশ।

এছাড়া ইতালিতে বাংলাদেশি পরিবারগুলোতে জন্ম হার কমার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। ২০২০ সালে তিন হাজার ৬২৯ জন নতুন বাংলাদেশি শিশু জন্ম নিলেও ২০২১ সালে সেটি দাঁড়ায় তিন হাজার ২১৮ জনে। প্রায় ১১.৩ শতাংশ কমেছে শিশু জন্মের হার।

প্রতিবেদনে ইতালির পরিসংখ্যান ব্যুরোর সূত্র দিয়ে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইতালিতে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৫৭১ জন, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৭৯.৯% কম।

৪৬ শতাংশের বসবাস উত্তর ইতালিতে

ইতালিতে বাংলাদেশিরা কোথায় বসবাস করেন সেটি নিয়েও বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে দেশটির শ্রম ও সামাজিক পরিকল্পনা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ইন্টিগ্রেশন ও অভিবাসন বিষয়ক দপ্তর।

তারা জানিয়েছেন, আনুমানিক ৪৬ শতাংশ বাংলাদেশি নাগরিক উত্তর ইতালির বিভিন্ন শহরে বাস করেন। বিশেষ করে, এ অঞ্চলের লোমবার্ডি শহরে ১৫.৭ শতাংশ বাংলাদেশির বসবাস। এ অঞ্চলের আরেক শহর ভেনেটোতে আছেন ১২.৪ শতাংশ বাংলাদেশি।

দক্ষিণ ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলে ১৭.৪ শতাংশ বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করছেন। এ অঞ্চলে প্রধানত ক্যাম্পানিয়া এবং সিসিলি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বসতি গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশিরা।

বাংলাদেশিদের বাকি ৩৬.৪ শতাংশ সেন্ট্রাল ইতালিতে বসবাস করেন। তবে মোট সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি বাস করেন সেন্ট্রাল ইতালির লাজিও অঞ্চলে। সেখানে মোট সংখ্যার ২৭.২ শতাংশ বাংলাদেশির অবস্থান। রোম লাজিও অঞ্চলের শহর।

ইতালির রাজধানী রোমের মধ্য-পূর্ব এলাকায় বাংলাদেশিদের শক্তিশালী উপস্থিতি লক্ষণীয়।

ইতালি কর্তৃপক্ষের মতে, অভিবাসীদের আঞ্চলিক ঘনত্বের মাত্রা একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সামাজিক একীকরণের ইতিবাচক স্তরের একটি সূচক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কারণ এটির মাধ্যমে তারা ‘অভিবাসী শৃঙ্খল’ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। যা অভিবাসীদের তাদের পরিচিত ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হতে সহায়তা করে। এটি দীর্ঘমেয়াদি অভিবাসন প্রক্রিয়ার একটি ঐতিহাসিক সূচকের প্রতিনিধিত্ব করে।

তবে একই সূচক শহরতলী বা উপ-পৌরসভা স্তরে বিবেচনায় নেওয়া হলে ইন্টিগ্রেশনের একটি নেতিবাচক অর্থের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি সম্ভাব্য আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতার সংকেত দেয় এবং তথাকথিত ‘ঘেটো’ অঞ্চল তৈরি করে।

২০২১ সালে ইতালিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য জারি করা নতুন রেসিডেন্স পারমিটের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৯৭৪টি। সংখ্যাটি আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

২০২০ সালে শুরু হওয়া করোনা মহামারির কারণে প্রশাসনিক কাজ স্থবির হয়ে পড়ায় ২০২১ সালের এমন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া কাজও বিভিন্ন বৈধতার আওতায় নতুন বৈধতা পাওয়া অভিবাসীদের রেসিডেন্ট প্রাপ্তির সংখ্যাও ২০২১ সালের সংখ্যায় প্রভাব ফেলেছে।

২০২১ সালে নতুন রেসিডেন্স পারমিটপ্রাপ্ত বাংলাদেশিদের ৪৪ শতাংশ পারিবারিক পুনর্মিলন ভিসায় এসেছিলেন। পারিবারিক ভিসায় আসা অভিবাসীদের অর্ধেকেরও বেশি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন।

দীর্ঘমেয়াদি রেসিডেন্স পারমিট নিয়ে ৫৬.২ শতাংশ

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের শুধু ২৮৬ জন বাংলাদেশি নাগরিক কাজের ভিসা নিয়ে ইতালিতে প্রবেশ করেছিলেন। ২০২১ সালে এই সংখ্যাটি ছিল দুই হাজার ৭৮ জন।

দীর্ঘমেয়াদি বসবাসের অনুমতি বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, ইতালীয় ভূখণ্ডে বাংলাদেশিদের স্থিতিশীলতার প্রক্রিয়া এখনো সম্পূর্ণরূপে পরিপক্ক হয়নি।

২০২১ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি রেসিডেন্স পারমিট নিয়ে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সংখ্যা ৫৬.২ শতাংশ। এসব ব্যক্তির মধ্যে প্রথম অংশটি পারিবারিক কারণে অর্থাৎ মা-বাবার উপস্থিতির কারণে বসবাস করছেন। দ্বিতীয় প্রধান সংখ্যক ব্যক্তিরা চাকরির কারণে দীর্ঘমেয়াদি পারমিট বহন করছেন।

ইতালি কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর দেশটিতে অবস্থানরত ১৬টি প্রধান দেশের অভিবাসীদের নিয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। শ্রম ও সামাজিক পরিকল্পনা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ডিরেক্টরেট এটির দায়িত্বে থাকে।

যেসব দেশের অভিবাসীদের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় সেগুলো হলো– মরক্কো, আলবেনিয়া, চীন, ইউক্রেন, ভারত, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, মিশর, পাকিস্তান, মলদোভা, শ্রীলঙ্কা, সেনেগাল, তিউনিশিয়া, নাইজেরিয়া, পেরু ও ইকুয়েডর।

 

সূত্র : ইনফোমাইগ্রেন্টস

 

 

 

তাসু/চখ