chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

অপরাধের ধরণ পাল্টে গেছে, শিকার হচ্ছেন নারী পুরুষ উভয়ে

চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শাহেদুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। মাস দু এক আগে একটি অপরিচিত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে ভিডিও কল আসলে তা রিসিভ করেন। অপর প্রান্ত থেকে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। কয়েকদিন পর ওই নম্বর থেকে একটি এডিট করা ভিডিও কলের স্কিনশট পাঠায় প্রতারক চক্র। তাদের চাহিদা মত টাকা না দিলে এডিট স্কিনশর্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকী দেয়া হয়। এক পর্যায়ে তিনি সিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগে অভিযোগ করলে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। এভাবে তথ্য প্রযুক্তির প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে অপরাধে নেমেছে সাইবার ক্রিমিনালরা। কোন কোন চক্র এডিট করা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকী দিয়ে করছে প্রতারণা। কোন চক্র আবার ই-কমার্স, ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতারণা করে বিস্তৃত করতে সাইবার অপরাধ জগত।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) ‘বাংলাদেশ সাইবার অপরাধ প্রবণতা-২০২২’- শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি সাইবার অপরাধের শিকার। ভুক্তভোগীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৪৩ দশমিক ২২ ও নারীদের সংখ্যা ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি এবং পর্নোগ্রাফির শিকার বেশি হচ্ছেন। পুরুষরা বেশি শিকার হচ্ছেন মোবাইল ব্যাংকিং ও এটিএম কার্ড হ্যাকিংয়ে। ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর, এই হার ৮০ দশমিক ৯০ শতাংশ। হয়রানির শিকারের পর ভুক্তভোগীদের ৭৩ দশমিক ৪ শতাংশই আইনের আশ্রয় নেন না। এছাড়া আইনের আশ্রয় নেয়া ভুক্তভোগীদের মাত্র ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ আইনি সেবার প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। লোকলজ্জার ভয়সহ বিভিন্ন কারণে অপরাধের বিষয়ে ভুক্তভোগীরা কোথাও অভিযোগ করেন না।

জরিপে সাইবার অপরাধের তুলনামূলক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রথম স্থানে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা, যার হার ২৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ২০২১ সালের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ২৮ দশমিক ৩১ শতাংশ, যা এবারের তুলনায় ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। তবে চিন্তার বিষয় এই যে, গতবারের প্রতিবেদনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের ঘটনা ছিল ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। কিন্তু এবার তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ, যা গতবারের তুলনায় ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। এছাড়াও যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও (পর্নোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানি এবং ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। যৌন হয়রানির পরিমাণ গতবার ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ছিল, কিন্তু সেটা এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে এবং ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা গতবারের প্রতিবেদনে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ পাওয়া গেলেও এবার তা ১ দশমিক ৮ শতাংশ বেড় গিয়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

অপরাধ ও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংশ্লিষ্ট বলছেন, তথ্য প্রযুক্তির আধুনিকায়নের ছোঁয়া লেগেছে অপরাধ জগতেও। অপরাধী চক্রগুলো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ফেলেছে একের পর এক অপরাধের জাল। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে অত্যাধুনিক অস্ত্র হিসেবে। রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারনা, গুজব ছড়ানো, হ্যাকিং, অনলাইন ব্যবসার নামে প্রতারণা, প্রযুক্তি ব্যবহার করে জন্ম নিবন্ধন জালিয়াতি, এনআইডি জালিয়াতি, পর্নোগ্রাফিসহ নানান অপরাধী চষে বেড়াচ্ছে সাইবার দুনিয়া। এগুলোর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ক্রেডিট কার্ড প্রতারণা, ই-কমার্স, এফ-কমার্স, অনলাইন জুয়া, ইমু হ্যাকিং, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা, এটিএম কার্ড জালিয়াতি, অপরিচিত নম্বর থেকে আসা ভিডিও কলের মাধ্যমে প্রতারণা। এছাড়া লোভনীয় অফারের লিংক পাঠিয়ে এতে ক্লিক করতে বলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেয়া এবং ম্যালওয়ার মাধ্যমে সাইবার অপরাধের অভিযোগও আসছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের কাছে। চট্টগ্রাম জেলা ও নগরীর বিভিন্ন থানায় প্রতি মাসে সাইবার অপরাধের দুই শতাধিক অভিযোগ জমা হয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন ইউনিটে। অভিযোগকারীদের ৫৫ শতাংশ থাকেন নারী এবং ৪৫ শতাংশ হচ্ছেন পুরুষ। যাদের বেশির ভাগরই বয়স ২৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে।

প্রযুক্তি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায, পুরুষের তুলনায় নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি এবং পর্নোগ্রাফির শিকার বেশি হয়েছেন। অন্যদিকে, নারীদের তুলনায় পুরুষরা মোবাইল ব্যাংকিং বা এটিএম কার্ড হ্যাকিংয়ের শিকার বেশি হয়েছেন। আর অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। অনেকে সাইবার অপরাধের শিকার হয়েও অভিযোগ করেন না। তাই আইনি প্রতিকারের বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং অপরাধের শিকার হলে দ্রুত নিকটস্থ থানায় যোগাযোগ করতে হবে। তাহলে আইনি প্রতিকার মিলবে।

প্রযুক্তিবীদ ড. ফয়সাল কামাল চৌধুরীর মতে- বেশির ভাগ ভুক্তভোগী নিজের অজ্ঞতার কারণেই ভিকটিমাইজ হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা হয় কারণে-অকারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী স্পর্শকাতর তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেন। পরে দেখা যায় সেই তথ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে প্রয়োজন ব্যবহারকারীদের সচেতনতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।

সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন জানান, তথ্য প্রযুক্তির প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। এক সময় সাইবার ক্রাইমের ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগই ছিল নারী। এখন ভুক্তভোগীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই হচ্ছেন পুরুষ। সচেতনতার অভাই বেশির ভাগ ভুক্তভোগী সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করার সময় সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে অপরিচিত কোন আইডি কিংবা নম্বর থেকে আসা লিংক সচেতন ভাবে এড়িয়ে যেতে হবে।’

চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালের পিপি মেজবাহ উদ্দিন জানান, ২০২১ সালে চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন হওয়ার পর থেকে ৭০০টি মামলার বিচার কাজ শুরু হয়েছে। ৭০০টি’র মত মামলা তদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে। রুজু হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিকৃত ছবি ও তথ্য প্রকাশ, ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত, রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে মানহানিকর তথ্য প্রকাশের অভিযোগে।