chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

প্রকৃতির প্রতিশোধে টনক নড়ছে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের সরাসরি ভুক্তভোগী যেসব দেশ তারা আদৌ তাদের এই প্রতিকূলতার জন্য দায়ী কিনা, এ নিয়ে আছে নানা মন্তব্য। অথচ যারা জলবায়ু সংকট মোকাবেলার জন্য বুলি কপচান, মূলত তাদের কারণেই বিশ্ব এখন সংকটের মুখোমুখি। তবে প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে ভুল করে না। যখন যুক্তরাষ্ট্র-চীনের ওপর প্রকৃতির প্রতিশোধ আসছে তখন নড়েচড়ে বসেছে বিশ্বের এ দুই মোড়ল।

সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের লিসা ফ্রেইডম্যানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কার্বন নিঃসরণ থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ির যাত্রা যাদের হাত ধরে শুরু হয়েছে, যারা শিল্প বিপ্লবকে নেতৃত্ব দিয়েছে সেই যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন জলবায়ু সংকটের জন্য প্রধান দায়ী দুটি দেশ।

সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জলবায়ু উপদেষ্টা জন কেরির সঙ্গে চীনা সরকারের এক প্রতিনিধি দল বৈশ্বিক জলবায়ু বিষয়ে বৈঠক করেন। এর আগেও এ দুই দেশের মধ্যে এ ধরণের বৈঠক হলেও লাভের লাভ তেমন একটা হয়নি। তবে পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র যখন নিজেরাই জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের শিকার হচ্ছেন, তখন টনক নড়তে শুরু করেছে তাদের। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র। যদি কোনোভাবে তাদের বোধোদয় হয় এবং এ ব্যাপারে তারা কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়, তাহলে এ যাত্রায় হয়তো পৃথিবী বড় রকমের সংকটের মুখ থেকে বেঁচে ফিরবে।

 

মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস করোনার সময় বলেছিলেন, করোনার পরে যদি আর কোনো মহামারি আসে সেটি হবে জলবায়ু সংক্রান্ত। তার জলবায়ু সংক্রান্ত বই ‘হাউ টু অ্যাভয়েড অ্যা ক্লাইমেট ডিজাস্টার’ এ বলা হয়েছে, ১৯৯০ সালে পৃথিবীতে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হতো বর্তমানে তারচেয়ে ৬৫ শতাংশ বেশি কার্বন নিঃসরণ হয়। পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে প্রতিবছর ৫১ বিলিয়ন টন গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে হবে। এটি যদি সম্ভব না হয়, তাহলে যেকোনো মহামারির থেকে বড় রকমের ঝুঁকির মুখে পড়বে বিশ্ব।

বিল গেটসের হিসাব অনুযায়ী, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনলে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করলে ২৭ শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা সম্ভব। এর বাইরে কলকারখানাগুলোকে পরিবেশবান্ধব করলে ৩১ শতাংশ, খাদ্য উৎপাদন ও যাতায়াত ব্যবস্থা থেকে যথাক্রমে ১৮ এবং ১৬ শতাংশ এবং পরিবেশবান্ধব বাসস্থান থেকে ৬ শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানো যাবে।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, যেসব দেশ জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্যোগের জন্য দায়ী; তাদের বাণিজ্য প্রতিযোগিতা ও উন্নয়নের নামে পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে ঢেলে দেয়ার বিষয়ে বোধোদয় কবে হবে তার ওপর নির্ভর করছে বিশ্বের ভবিষ্যৎ।

যেখানে প্যারিস চুক্তিতে (কপ২১) বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ৪৩ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে; সেখানে এখন পর্যন্ত চীন প্রতিবছর ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ করছে এবং এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় ৬ বিলিয়ন মেট্রিক টন।

মূলত বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের গল্প শুরু শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে। সে হিসেবে ১৮৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র একাই কার্বন নিঃসরণ করেছে ৫০৯ বিলিয়ন মেট্রিক টন। অন্যদিকে একই সময়ে চীনের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ২৮৪ বিলিয়ন মেট্রিক টন। মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ হিসাব করলে, যুক্তরাষ্ট্রে একজন মানুষের বার্ষিক কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ১৭ দশমিক ৬ টন। চীনে মাথাপিছু এর পরিমাণ ১০ দশমিক ১ টন।

জলবায়ু পরিবর্তন রোধে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ কী?

ওবামা প্রশাসনের লক্ষ্য ছিল, ২০২৫ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ২৬ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা। একই সূত্র ধরে বাইডেন প্রশাসনও বলছে, তারা চলতি দশকেই কার্বন নিঃসরণ ৫০-৫২ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনবে। আর ২০৫০ সালের মধ্যে এমন ব্যবস্থা করবে, যাতে করে নতুন করে আর কার্বন নিঃসরিত না হয়।

অন্যদিকে চীন ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নিয়ে আসবে বলে জানান দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এ লক্ষ্যে এখন থেকেই জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে বায়ু, সৌর ও পারমাণবিক শক্তি ২৫ শতাংশ বেশি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু করেছে চীন।

যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশটি ২০১৩ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করেনি। এছাড়া গত এক দশকে দেশটি ৪০ শতাংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। তবে এ ব্যাপারে চীন অনেকটাই উদাসীন। সারাবিশ্বে চীন একা যে পরিমাণ কয়লা পোড়ায় তার ধারে কাছেও কেউ নেই। সম্প্রতি চীন ১০৬ গিগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে, যা জলবায়ুকে আরও বিরূপ করে তুলবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

একদিকে চীন গড়ে তুলছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র অন্যদিকে ক্লিন এনার্জিতে (কার্বন নিঃসরণ করে না এমন জ্বালানি) দেশটি বিনিয়োগ করেছে ৫৪৬ বিলিয়ন ডলার। এদিকে ক্লিন এনার্জিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ১৪১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে নবায়নযোগ্য জ্বালানী উৎপাদনে চীনের সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার গিগাওয়াট।

জন কেরি তার সাম্প্রতিক চীন সফরে বলেছেন, জলবায়ু বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে রাজনীতি থেকে বের হয়ে বৈশ্বিক শান্তির দিকে জোর দিতে হবে। সারাবিশ্ব এখন বৃহৎ এই দুটি দেশের উদ্যোগের দিকে তাকিয়ে আছে।

যেসময় জন কেরি চীনকে নিয়ে জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্যোগ মোকাবেলার কথা বলছেন, ঠিক তখনই চীনের জিনজিয়াং শহরে তাপমাত্রা ৫২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস; যা ভেঙে দিয়েছে বিগত বছরের সব রেকর্ড। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া এবং টেক্সাসের তাপমাত্রাও গড়েছে নতুন রেকর্ড। জলবায়ুর প্রভাব যখন সরাসরি আঘাত হেনেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনে তখন বিশ্বে দূষণের জন্য দায়ী এ দুই দেশের টনক না নড়ে আর উপায় নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

এই বিভাগের আরও খবর