chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

গ্রামের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর অভিযানে যান শহরেও!



চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় অনিয়মের অভিযোগে মনোয়ারা বেগম মনি নামে এক স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে শোকজ (কৈফিয়ত তলব) করা হয়েছে। অভিযুক্ত মনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে নিজ কর্মস্থলের বাইরে গিয়ে অভিযানে অংশগ্রহণ ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়সহ নানা অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনে লিখিত অভিযোগের পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে মনোয়ারা বেগম মনির অনিয়মের বিষয়টি প্রকাশ্যে উঠে আসে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সহকারী মনোয়ারা বেগম সংযুক্তিতে কর্ণফুলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাময়িকভাবে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর নিয়োজিত থাকা সত্ত্বেও সেখানে পরিচালিত মোবাইল কোর্টে উপস্থিত ছিলেন মনোয়ারা বেগম। বিষয়টি বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও পত্রিকার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।

নিজের কর্মস্থলের এলাকা ছাড়া বিনা অনুমতিতে ভিন্ন এলাকায় এ ধরনের ‘মনগড়া’ দায়িত্বপালন বিধিবহির্ভূত ও অনভিপ্রেত উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ওই দিন মনোয়ারা বেগমের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী জুলধা ইউনিয়নের পাইপের গোড়া বাজারে অবস্থান করার কথা ছিল। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তার এভাবে নির্ধারিত এলাকার বাইরে অবস্থান করা প্রচলিত সরকারি কর্মচারী আচরণ ও শৃঙ্খলা বিধি পরিপন্থী। 

বিজ্ঞপ্তিতে মনোয়ারা বেগমকে এ বিষয়ে কারণ দর্শানো, জবাবের কপি এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকা- থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার নামা নিয়ে সিভিল সার্জন কার্যালয়ে প্রেরণ এবং দৈনন্দিন হাজিরা খাতায় তার স্বাক্ষর ও মুভমেন্ট রেজিস্ট্রার ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এর ধারাবাহিকতায় একইদিন কর্ণফুলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এস এম নাওশেদ রিয়াদ স্বাক্ষরিত এক নোটিশে অভিযুক্ত মনোয়ারা বেগম মনিকে শোকজ করা হয়। ওই নোটিশে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং চট্টগ্রাম জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়কের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মনোয়ারা বেগমের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হয়।

শোকজ নোটিশে বলা হয়, গত ৭ ফেব্রুয়ারি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই হাটহাজারী উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে নিয়মবহির্ভূতভাবে অংশগ্রহণ করেন মনোয়ারা বেগম। এ কারণে তার বিরুদ্ধে কেন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তা জানতে চেয়ে তিন কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখা দিতে বলা হয়।

জানা যায়, এরআগেও নিজ কর্মস্থল ও এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে চট্টগ্রাম নগরী ও বিভিন্ন উপজেলায় বেশ কয়েকবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে অংশ নেন মনোয়ারা বেগম। সর্বশেষ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সোবহানের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানেও অংশ নেন উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত স্যানিটারি ইন্সপেক্টর মনোয়ারা বেগম। এছাড়া আলোচিত এই স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি ও স্বাস্থ্য সনদ প্রদানের নামে টাকা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে।

শুধু তাই নয়, ব্যবসায়ীদের হয়রানি ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনার হুমকি দিয়ে মনোয়ারা বেগম ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেন বলেও অভিযোগ করেন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী। মনোয়ারা বেগমের অনৈতিক কর্মকা-ের একজন ভুক্তভোগী আবদুল করিম গত ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবর এক লিখিত অভিযোগ দেন। আবদুল করিম কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্যারটেক ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি ও আহমদ আলী তালুকদার জামে মসজিদের মোতোয়াল্লি।

ভুক্তভোগী আবদুল করিম নিজের লিখিত অভিযোগে বলেন, কর্ণফুলী উপজেলায় স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, স্বাস্থ্য সনদের নামে টাকা আদায় এবং চাঁদা না দেওয়া বা সনদের টাকা দিতে না চাইলে মিথ্যা তথ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে হয়রানি করা হয়। গত ৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে আমার এলাকার নুর সুইটস নামের একটি মিষ্টি কারখানায় অভিযানের খবর পাই। আমি সেখানে গিয়ে দেখতে পাই নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের ম্যাজিস্ট্রেট মো. সোহেল রানাসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তি অভিযান পরিচালনা করছেন। তখন আমি তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি এবং জানাই যে, এক মাস আগেও এই প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এখন আবার জরিমানা করা হলে স্বল্প পুঁজির এই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যাবে। আর এতে অনেক লোকের আয়-রুজি বন্ধ হলে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো কষ্টে পড়বে।

অভিযোগে তিনি আরও বলেন, আমার কোনো কথায় কর্ণপাত না করেই কারখানার ম্যানেজার রাজিবকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এসময় টাকা দিতে দেরি হওয়ায় যে প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদের কারখানায় রেখে আমাকে পুলিশ আটক করে গাড়িতে তোলে। এরপর কারখানা থেকে অন্তত ৫০০ গজ দূরে মইজ্যারটেক পুলিশ বক্সের সামনে নিয়ে যায়। পরে নগদ এক লাখ টাকা দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে আনা হয়। অথচ আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই ছিল না। ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি হওয়ায় দায়িত্ব পালনে আমি সেখানে উপস্থিত হই এবং কথা বলি। তারপরও তারা আমাকে আটকের পর হেনস্থার মাধ্যমে টাকা আদায় করেছে।

আবদুল করিম আরও বলেন, পরে আমি স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি ঘটনার একদিন আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি স্যানিটারি ইন্সপেক্টর মনোয়ারা বেগম মনি দুইজন সঙ্গীকে নিয়ে মইজ্যারটেকের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ব্যবসায়ীদেরকে শাসিয়ে যান। তাদের কথা না শুনলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা বা মামলা দেওয়া হবে বলেও শাসানো হয়। নুর সুইটসের মালিক আমাকে জানান ইতিপূর্বে মনোয়ারা বেগম মনি নুর সুইটসের কর্মচারীদের স্বাস্থ্য সনদ দেওয়ার কথা বলে আট হাজার টাকা নেন। পরে সনদ না দিয়ে হয়রানি করার কারণে ওই টাকা ফেরত চাওয়া হয়। কিন্তু টাকা ফেরত না দিয়ে উল্টো এক মাস আগে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সোবহান, জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা ফারহান ইসলাম ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ইয়াছিনুল হক চৌধুরীকে এনে মনোয়ারা বেগম মনি একটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন। এদিন ওই প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এখতিয়ার বহির্ভূত প্রসিকিউটরের মাধ্যমে সেই মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়। এতে আরও ক্ষিপ্ত হন মনোয়ারা বেগম। পরে ৪ ফেব্রুয়ারি দোকানে দোকানে গিয়ে শাসিয়ে এবং ৬ ফেব্রুয়ারি ফের মোবাইল কোর্টের অভিযান পরিচালনা করা হয়।

লিখিত সেই অভিযোগে ভুক্তভোগী আবদুল করিম স্থানীয় ব্যবসায়ীদের হয়রানি বন্ধ ও অভিযুক্ত মনোয়ারা বেগম মনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মনোয়ারা বেগম মনির মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি এ প্রতিবেদকের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী ও জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা ফারহান ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, যাকে যে এলাকায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই এলাকার বাইরে অভিযানে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেউ গেলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর