chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

একই গ্রামে বাংলাদেশি ও ভারতীয় ৪০ পরিবারের বসবাস

সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী ইছামতি নদীর ওপারে ভারতবর্ষ আর এপারে বাংলাদেশ। এখানে বিভক্ত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের মানচিত্র। ইছামতি নদীর ধার ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এমন এক জনপদ যাদের বসবাস এক সঙ্গে হলেও তারা ভিন্ন দুই দেশের নাগরিক।

এখানে একই সঙ্গে বসবাস করছেন বাংলাদেশ ও ভারতের ৪০টি পরিবারের প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ। দেখে বোঝার সাধ্য নেই, দুই দেশের দুই সংস্কৃতির মানুষ এক সঙ্গে বসবাস করে আসছেন দীর্ঘ সময় ধরে। ইছামতি নদীর ধার ঘেষে গড়ে ওঠা এই জনপদে সবার মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট সৌজন্যবোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধ।

সীমানায় বিভক্তি থাকলেও এখানে নেই কোনো সংঘাত কিংবা বিশৃঙ্খলা। দুই দেশের দুই ভাষার মানুষ একই উঠানে বসবাস করলেও নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। স্থানটিতে দুই দেশের মানুষের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে জামে মসজিদ। যেখানে নিয়মিত দুই বাংলার মুসল্লিরা এক সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন। দীর্ঘ কয়েক বছর যাবৎ এভাবে বসবাস করলেও কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটেনি এই জনপদে।

সাতক্ষীরা সদরের ভোমরা স্থলবন্দর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ সীমান্তে ইছামতি নদীর তীরে অবস্থিত হাড়দ্দহা গ্রাম। গ্রামটিতে বসবাস করেন বাংলাদেশি ২০টি পরিবার। এখানে একই সঙ্গে ভারতীয় ২০ পরিবার বসবাস করেন। একই গ্রামের মধ্য রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানা রেখা। ভারতের বসিরহাট থানাধীন পানিতর নামক গ্রামটি এখানে অবস্থিত। মূলত ভারতের পানিতর গ্রাম ও  সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর সংলগ্ন হাড়দ্দহা গ্রামের বাসিন্দারা প্রায় ১৮ বিঘা জায়গা জুড়ে বসবাস করছেন দুই দেশের সীমান্তবর্তী এই জায়গাটিতে। নিজেদের উৎসবে কিংবা বিপদে একে অন্যের পাশে বন্ধুর মতো থাকেন সব সময়। মানচিত্রে সীমারেখা ভিন্ন হলেও এই জনপদের দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে নেই কোনো ভেদাভেদ।

দেখা গেছে, যেখানে বাংলাদেশী নাগরিকের বসতবাড়ি ঠিক তার উঠানে রয়েছে ভারতীয়দের বসতঘর। শুরুর দিকে বাংলাদেশি ১৫টি পরিবার ও ভারতীয় ১৫টি পরিবার এখানে বসবাস শুরু করলেও বর্তমান দুই দেশের প্রায় ৪০টি পরিবার এক সঙ্গে বসবাস করছেন। দেশ বিভক্তির পর থেকে বসতিদের মধ্যে সীমানা বিভক্তিকরণের সূচনা হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে এই জনপদে ভারতীয় ও বাংলাদেশীদের মধ্যে বিবাহ বন্ধনের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন হলেও বর্তমানে সেটি আর হয় না। দেশের আইনসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এখন নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন তৈরির সুযোগ কমেছে। বাংলাদেশি নাগরিকের ঘর থেকে ভারতীয়দের ঘরে যেতে সময় লাগে কয়েক সেকেন্ড। দূরত্বটা কয়েক সেকেন্ডের হলেও তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে দুই বাংলার এক অনন্যা মেলবন্ধন।

দেখা গেছে, বিকেল গড়ালে বাংলাদেশি ও ভারতীয় বাচ্চারা একই মাঠে খেলছেন, গাইছেন যে যার ভাষাতে। নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছেন নিজ দেশের অঙ্গভঙ্গি দিয়ে। ভাষার ভিন্নতা থাকলেও তারা উভয়ে উভয়ের মনোভাব বুঝতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

বশিরহাট থানার পানিরতর গ্রামের বাসিন্দা হাসান গাজী বলেন, বাংলাদেশিদের সঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে একে অপরের বন্ধুতে রুপান্তর হয়েছে। এক সঙ্গে পুকুরে গোসল করি, এক সঙ্গে দোকানে গিয়ে চা খাই। কখনো বুঝতে পারি না আমরা দুই দেশের লোক এখানে বসবাস করছি। কখনো বাংলাদেশি কারও বিপদ বা অসুস্থ হলে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ায়। যদিও কখনো একে অপরের সঙ্গে মনোমালিন্য বা ঝগড়া হয় না তারপরেও সামান্যতম কিছু হলে সেটা বিজিবি ও বিএসএফ এসে সমঝোতা করে দেয়। এই যাবৎকালে কখনো কোনো বড় সমস্যা তৈরি হয়নি। এখানে বসবাস করতে করতে একে অপরের আত্মীয় হয়ে গেছে। বাংলাদেশিরা ভারতীয়দের সঙ্গে বিয়ের মাধ্যমে আত্মীয়তা করেছেন। উভয়ের মধ্য একটি সুন্দর বন্ধন তৈরি হয়েছে। মানচিত্রের সীমানা ভিন্ন হলেও আমাদের সবার আত্মার টান অভিন্ন।

ভারতীয় পানিতর গ্রামের বাসিন্দা মোহতাব বলেন, দুই দেশের লোকের সমন্বয়ে এখানে একটি মসজিদ তৈরি করেছি। যে মসজিদটির নাম পানিতর জিরো পয়েন্ট জামে মসজিদ। এখানে বসবাস করা দুই দেশের ৪০ পরিবার একত্রে নামাজ পড়া হয়। এক সঙ্গে বসবাস করা হলেও ধর্ম-বর্ণ কিংবা বৈষম্যের সৃষ্টি হয় না কখনো। আমাদের কোনো কিছু ধার লাগলে বাংলাদেশিদের থেকে সেটা নিতে পারি বা বাংলাদেশিদের কিছু লাগলে আমরা ধার দিয়ে থাকি। একত্রে এক সঙ্গে শ্রম দিয়ে অর্থ উপার্জন করে সুন্দরভাবে বেঁচে আছি এখানে।

বাংলাদেশের হাড়দ্দহা গ্রামের বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, বিকেল গড়ালে ইছামতি নদীর তীরবর্তী মাঠে ভারতীয় ও বাংলাদেশিরা একত্রে খেলাধুলা করি। তখন দেশ ও সংস্কৃতি ভুলে আমরা একে অন্যের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলি। আবার যখন ভারতীয়দের উৎসব হয় তখন আমরা সেটাতে অংশগ্রহণ করি আবার বাংলাদেশিদের আনন্দ উৎসবে ভারতীয়রা স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। এক সঙ্গে বসবাস করতে কোনো প্রকার বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় না কখনো।

হাড়দ্দহা গ্রামের আবু জাফর বলেন, দুই বাংলার ৪০ পরিবার এক সঙ্গে বসবাস করলেও আজ পর্যন্ত কোনো আপত্তিকর ঘটনার সৃষ্টি হয়নি। দুই দেশের মানুষ এক সঙ্গে এক উঠানে বসবাস করার যে অনুভূতি সেটা প্রকাশ করার ভাষা নেই। ভারতীয়রা ভারতের ইটনা বাজার বা বশিরহাটে গিয়ে দৈন্দিন প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে থাকেন। আবার পাশ্ববর্তী বাংলাদেশের সীমানায় থাকা দোকানেও আসার কিছুটা সুযোগ আছে ভারতীয়দের। সেখানে এক সঙ্গে চা খাওয়ার, আড্ডা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয় রোজ।

স্থানীয় বাংলাদেশ ও ভারতের বাসিন্দাদের যৌথ উদ্যোগে তৈরিকৃত পানিতর জামে মসজিদের ঈমাম মাওলানা আব্দুল আজিজ। তিনি ভারতের বশিরহাট উত্তর চব্বিশ পরগনার বাসিন্দা। তিন বছর মসজিদটির ঈমামের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। দুই দেশের সবাই মিলে তার বেতন দিয়ে থাকেন।

ঈমাম মাওলানা আব্দুল আজিজ বলেন, বশিরহাট থেকে আরও ৩০ কিলোমিটার ভেতরে আমার বাড়ি। তিন বছর যাবৎ সীমান্তবর্তী এই মসজিদটির দায়িত্বে রয়েছি আমি। মসজিদটি একটি স্পর্শকাতর স্থানে অবস্থিত এখানে উভয় দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা রয়েছে। এই মহল্লায় দুদেশের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে শান্তিপূর্ণভাবে। নামাজের সময় হলে দুই দেশের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে। আমার তিন বেলার খাবার ও বেতন দুই দেশের বাসিন্দারা মিলেমিশে বহন করে। দুই বাংলার মানুষের মধ্যে ভালোবাসা দেখে বোঝার উপায় নেই যে তাদের মানচিত্র ভিন্ন। তাছাড়া দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফ সব সময় সার্বিক বিষয়ে সহযোগিতা করে থাকেন।

ভোমরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইসরাফিল গাজী বলেন, সীমান্তবর্তী হাড়দ্দহা গ্রামে বাংলাদেশিদের সঙ্গে ভারতীয়রা শান্তিপূূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। সেখানকার বাঙ্গালিরা সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো করার লক্ষ্যে রাস্তা পাকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুই দেশের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাদের বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।

সাতক্ষীরা ৩৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল মো. আশরাফুল হক বলেন, বিজিবি সার্বক্ষণিক তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছেন। সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয়রা বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করার চেষ্টা করে। তাদের বৈধ কাজ কাগজপত্র না থাকায় প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে কোনো সমস্যা তৈরি হলে তাৎক্ষণিকভাবে বিজিবির হস্তক্ষেপে সেটা সমাধান করা হয়ে থাকে। সবকিছু মিলিয়ে তারা উভয় দেশের নাগরিক শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু এলাকাটি দুই দেশের সীমানায় অবস্থিত তাই সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সর্বদা জোরদার থাকে। তাছাড়া কোনো ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড যাতে না ঘটে সে বিষয়ে নজরদারি করা হয়ে থাকে।

 

 

 

 

তাসু/চখ

 

এই বিভাগের আরও খবর