নিঃসঙ্গতা কিছুটা দূর করেছে ‘স্মার্ট ফোন’
বিশ্ব প্রবীণ দিবস
নাতি নাতনিদের কাছে পাই না।কষ্ট লাগে, একাকিত্ব ও অসহায়ত্ববোধ করি। তবে যখন ফোনে ভিডিও কলে কথা বলি সব দুঃখ,বেদনা দূর হয়ে যায়। প্রায় সময় কথা বলি। স্মার্ট ফোন আমার নিঃসঙ্গতা দূর করেছে। এ কথাগুলো বলছিলেন ষাটউর্ধ মমতাজ বেগম।
গতকাল নগরীর পার্কভিউ হাসপাতালে কথা হয় তার সাথে।আলাপচারিতায় আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস সর্ম্পকে জানতে চাইলে আক্ষেপের সুরে বলেন প্রতিদিনই প্রবীণ দিবস মনে হয়।বয়স বাড়ার সঙ্গে মানুষের একাকিত্ব ও অসহায়ত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি জানান, ছোটবোনের ছেলেকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন।তার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে।কর্মসূত্রে বউ বাচ্চাসহ ছেলেরা বিদেশে থাকে আর, মেয়েদের আগেই বিয়ে দিয়েছেন, বর্তমানে ছোটমেয়ের সাথে।
শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ছোটকালে দাদাদাদির সাথে কানামাছি খেলতাম , রাজা বাদশার গল্প করত।আমার দাদিমা মজার মজার ভৌতিক গল্প শুনাতো, বলতে গেলে আমার খেলার সাথী ছিল দাদিমা। আহা! কত আনন্দের দিন কাটাতাম, এখন আর দেখা যায় না।
তিনি আরো জানান, একসময় পরিবারগুলো আন্তরিকতা স্নেহ ভালোবাসার বন্ধনে আটকে ছিল। অনেক পরিবারেই এখন আর সে অবস্থা নেই। প্রায় সবই অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।শহর বা গ্রামে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার তৈরি হচ্ছে।এই পরিবর্তনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন প্রবীণরা।তাদের একাকিত্বের দুঃখ বেদনা, অব্যক্ত কথা শোনার মানুষ ক্রমেই কমে আসছে।যন্ত্রণা বাড়ছে নিঃসঙ্গ বয়স্ক মানুষগুলোর।
রবিবার (১ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। জাতিসংঘের আহ্বানে ১৯৯১ সাল থেকে অক্টোবরের প্রথম দিনটিকে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আজ পালিত হচ্ছে ৩৩তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস।এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় প্রবীণদের জন্য প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রজন্মের ভূমিকা।
একজন মানুষের জীবনচক্র যথা- নবজাতককাল, শৈশবকাল, কিশোরকাল, প্রাপ্তবয়স্ককাল এবং বার্ধক্যকাল। এই ৫টি ধাপের শেষ ধাপ হল বার্ধক্যকাল।বার্ধক্য কোনো রোগ নয়।এটা জীবনের চলমান একটি প্রক্রিয়া। এই চলমান প্রক্রিয়ায় একজন প্রবীণকে তার শেষ জীবনে বিশেষ করে আগে থেকে স্বাস্থ্য সচেতন না হলে বহুবিধ স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পতিত হতে হয়।একালে অবস্থানরত মানুষগুলোকে আমরা বলি প্রবীণ।‘প্রবীণ’ যাত্রাপথ ৬০ বছর হতে শুরু করে জীবনের সমাপ্তি পর্যন্ত ধরা হয়।
‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯ জন, ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭.৪৭ শতাংশ। জাতিসংঘের জনসংখ্যা উন্নয়ন তহবিলের প্রাক্কলন বলছে, ২০২৫-২৬ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে ২ কোটি। ২০৫০ সালে ওই সংখ্যা হবে সাড়ে ৪ কোটি, যা তখনকার জনসংখ্যার ২১ শতাংশ হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবীণ গোষ্ঠীর জন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের এগিয়ে আসতে হবে। একজন প্রবীণ জ্ঞানে, অভিজ্ঞতায়, জীবন দর্শনে প্রাজ্ঞ। তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। প্রবীণদের করুণা নয়, সম্মানের চোখে দেখতে হবে, যা তাদের অধিকার।
কেউ কর্মসূত্রে প্রিয় মা-বাবাকে বাড়িতে রেখে বিদেশে আছেন। কেউ দেশেরই বড় কোনো শহরে চাকরি বা ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। বৃদ্ধ মা-বাবাকে সময়ই দিতে পারছেন না। অপর দিকে অন্দরমহলে থাকা লোকজনও প্রবীণদের খোঁজ রাখছে না। গ্রাম থেকে শহরের অনেক স্থানেই এমন চিত্রে দেখা মিলবে। অর্থ-সম্পদ, সুপ্রতিষ্ঠিত ছেলে-মেয়ে থাকার পরও অনেক প্রবীণ মা-বাবার স্থান হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। এমন সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
প্রতিবছরের ন্যায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয় দিবসটি।নিঃসঙ্গ বয়স্ক মানুষগুলোর দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা বাণী দিয়েছেন।এতে প্রবীণদের সুরক্ষিত রাখতে তারা সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা আয়োজন থাকে। বিশেষ করে প্রবীণদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্ণীল আয়োজন সবার চোখে পড়ে।ব্যক্তি পর্যায়েও এই দিনটি ছুঁয়ে যায় প্রবীণদের। তাই তারা ভালো থাকতে চান জীবনের শেষ দিন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। এই চাওয়া কী অযৌক্তিক বা খুব বেশি কিছু?
চখ/এআর