chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

হাটহাজারীতে নাই হয়ে গেল শতবর্ষী পুকুর

সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ: বাগানবাড়ির জন্য জমি নয়, “মাছ চাষের” কথা বলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শতবর্ষী আস্ত একটা পুকুর গিলে ফেললেন মোহাম্মদ রফিক ও তার ভগ্নিপতি আবুল হাশেম।  শুধু পুকুর নয়, তাদের ‘শকুন’ দৃষ্টি থেকে বাদ যায়নি শতবর্ষী শ্মশানও৷

২০১১ সালে স্থানীয় কৃষ্ণ প্রসাদ ঘোষ ও অজিত কুমার ঘোষ গং থেকে মাছ চাষের কথা বলে ১ একর ২৪ শতক আয়তনের পুকুরটি কিনে নেন তারা। কিছুদিন মাছ চাষ করলেও পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে তাদের আসল স্বরূপ। পরিকল্পনা করেন মাটি ভরাট করে বাগানবাড়িসহ বাণিজ্যিক বিভিন্ন স্থাপনা ৷

২০১৫ সালের দিকে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনকে তোয়াক্কা না করে রাতের আঁধারে ভরাট করে ফেলা হয় পুকুরটি। কিছুদিনের মধ্যে পাল্টে যায় পুকুরটির ‘ভৌগলিক’ চেহেরা। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় পুকুর। মাটি ভরাট করে পুকুরের চারপাশে নির্মাণ হয় সীমানা দেয়াল। আবার দুইভাগে ভাগ করে পুকুরের মাঝখানে নির্মাণ করা হয় আরেকটি পাকা দেয়াল৷

বছর তিনেক আগেও গুগল সার্চ করে সেই পুকুরের  অস্তিত্ব পাওয়া যেত। এখন সেই পুকুরের অস্তিত্ব নেই৷ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গুগল সার্চ করলে এখন দেখা যাবে পুকুর নয়, যেন বাগানবাড়ি ও কৃষি জমি।

সরেজমিন গেলে যেতে হবে হাটহাজারী উপজেলার বড়দিঘির উত্তরপাড়ের রাস্তা ধরে আধা কিলোমিটার পূর্বদিকে। সেখানে গেলে হাতের ডানে চোখে পড়বে নাথপাড়া ও দুর্গাপাড়া। পূর্বদিকে কৃষ্ণ ঘোষের বাড়ি। বিলুপ্ত পুকুরের উত্তরপাশে আছে সংখ্যালঘুদের অসংখ্য বাড়িঘর।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পুকুর গিলে ফেলা দুই সহোদরের বাড়িও পার্শ্ববর্তী গ্রাম ‘আহনের পাড়ায়’। পেশায় তারা ব্যবসায়ী।  বড়ভাই লিয়াকত আলী ছিলেন স্থানীয় চিকনদন্ডী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। পুকুরটি ভরাটের সময় স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের আপত্তি জানালেও তা ধোপে টিকেনি।

স্থানীয় ভুমি অফিসের রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা যায়, চিকনদণ্ডী মৌজায় পুকুরটির বিএস দাগ ৯৭৩৮। এই দাগের খতিয়ান নং ১৪৪৭। খতিয়ানে ভুমির পরিমাণ ১ একর ২৪ শতক, জমির শ্রেণি-পুকুর লিপিবদ্ধ আছে। বিএস খতিয়ান মতে এই পুকুরের মূল মালিক কৃষ্ণ প্রসাদ ঘোষ, নারায়ণ প্রসাদ ঘোষ, পিতা-মনিন্দ্র লাল। অজিত কুমার ঘোষ, রঞ্জিত কুমার ঘোষ, পিতা-বিমল কান্তি ঘোষ। সর্বসাং-চিকনদন্ডী, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, হাটহাজারী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে ২০১১ সালের ৫ মে ৭৩৪/১১ নং নামজারি জমাভাগ মামলা মূলে ১একর ২০ শতক পুকুর সম্পত্তির মালিক (সৃজিত খতিয়ান নং-৫৯২২) মো. রফিক এবং আবুল হাশেম। স্থানীয় সংখ্যালঘুদের অভিযোগ, তাদের দখলযজ্ঞ থেকে বাদ যায়নি একই মৌজার অধীন  বিএস ১১৫৫০ দাগের শতবর্ষী শ্মশানও। মাটি কেটে ফেলার ফলে শ্মশানটিও আজ বিলুপ্ত প্রায়।

জানা গেছে, শতবছর ধরে নাথপাড়া, কৃষ্ণ ঘোষ বাড়ি, দুর্গাপাড়া ও আশপাশের এলাকার পানির অন্যতম আধার হিসেবে পুকুরটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিল। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও বন্যা–পরবর্তী সময়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে এই পুকুরের অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়া চিকনদণ্ডী ইউনিয়নের ঐতিহাসিক সৌন্দর্য এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশব্যবস্থা রক্ষার্থে এ পুকুরের বিশেষ অবদান ছিল।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া, আইন অমান্য করে পুকুরটি ভরাট করে ফেলেন আবুল হাশেম ও রফিক। ভরাট করে ফেলা শতবর্ষী পুকুর- শ্মশান পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন এলাকাবাসী। ভরাটকৃত মাটি অপসারণ করে পুকুরটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবিও জানান তারা।

স্থানীয় বাসিন্দা নারায়ণ দাশ বলেন, “পুকুর ভরাট করে ফেলায় আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি পাবে। এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন হবে।” নাথপাড়ার পাশের গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বিলুপ্ত হওয়া পুকুরের অদূরে একটি টং দোকান পরিচালনা করেন। এই প্রসঙ্গে তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, “৭/৮ বছর আগে পুকুরটি ভরাট করে ফেলেন আবুল হাশেম। স্থানীয়রা তাকে ‘জাপাইন্নে’ হিসেবে চিনেন। কারণ তিনি এক একসময় জাপান প্রবাসী ছিলেন। বিলুপ্ত হওয়া বিশালাকার পুকুরটি কৃষ্ণ ঘোষদের পুকুর হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিল। এখন সবাই বলে ‘জাপাইন্নে’র পুকুর। তবে ৭/৮ বছর পরে কেন পুকুরটি নিয়ে প্রশ্ন উঠল, এমন প্রশ্নএ রাখেন জাহাঙ্গীর।

দিলীপ শীল নামের স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, পুকুরটি ঘিরে যারা বসবাস করেন তাদের বেশিরভাগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন। পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। তবে পুকুর রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান দিলীপ। পুকুর ভরাট এবং শ্মশান দখলের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন আবুল হাশেম। এদিকে হাটহাজারী উপজেলার চিকনদন্ডী ইউনিয়নে বিশাল আয়তনের পুকুরটি ভরাটের বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোমিনুর রহমান।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার আজ সোমবার  সকালে চট্টলার খবরকে বলেন, “খতিয়ানে ভরাট করে ফেলা ভূমিটি পুকুর শ্রেণি হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর