ভবঘুরে নারীর রহস্যময় মৃত্যু , দেখলো না পরিবার
মেহেদী হাসান কামরুলঃ জীবনের বাকে মানুষ কতই না রঙিন ছবি আঁকে। কিন্তু সেই ছবি কি সবসময় রঙিন হয়? হয় না। যেমনটা হয় নি কিশোরগঞ্জের মেয়ে রাজিয়া খাতুনের (৩৮)। যে জীবনের স্বপ্নের সে জীবন ছেড়ে গেছে পক্ষাঘাত মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
শুরুতে অজ্ঞাত হিসেবে উদ্ধার হলেও পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআইর)র তথ্য প্রযুক্তি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহের মাধ্যমে তার পরিচয় শনাক্ত করা হয়। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত পরিবারও আসতে পারেনি প্রিয় সন্তানের কবরটি শেষ বারের মতো দেখতে। পরিবার যখন জানতে পারে ততক্ষণে বাবা-মায়ের আদরের রাজিয়া অজ্ঞাত লাশের পরিচয় নিয়ে আঞ্জুমান মুফিদুলের হাতে সমাহিত হয়েছেন মাটির ছোট্ট ঘরে। যেখানে রাজিয়ার অন্তিম যাত্রা।
ভবঘুরে রাজিয়াকে ভাঙা হাত-পা, মাথায় গুরুতর আঘাত, রক্তাক্ত, বিবস্ত্র, নিথর অবস্থায় উদ্ধার করেছে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানা পুলিশ। দায়িত্বশীল কোনও সংস্থা এই মৃ্ত্যুর সঠিক কারণ সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেনি। পুলিশও ব্যস্ত ধোঁয়াশায় ঘেরা এই মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে।প্রাথমিকভাবে এটিকে পুলিশ রেল দূর্ঘটনায় মৃত্যু বললেও গণমাধ্যমের অনুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা।
গত শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) সকাল থেকে একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হতে থাকে। ভাইরাল হওয়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি রেল সেতুতে ঝুলে আছেন রাজিয়া, পা দুটি নিচের দিকে ঝুলে আছে। তার পরনের পায়জামা খোলা। সামান্য কিছু অংশ পায়ের গোড়ালির সাথে আটকে গেছে। আর হাত দুটি অপর প্রান্তে ঝুলে আছে। মাঝখানের পিঠ ও কোমড়ের অংশটুকু ব্রীজের পাটাতনে পড়ে আছে। ঘটনাস্থল মিরসরাইয়ের ধুমঘাট রেল সেতু। যা ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনকে ফেনী নদীর সাথে সংযুক্ত করে দিয়েছে। ধুমঘাট পর্যন্ত দেখভালের দায়িত্ব সীতাকুণ্ড রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির।
স্বাভাবিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখে মনে হতে পারে তাকে ধষর্ণের পর খুন করে মরদেহ ব্রীজের পাটাতনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। অথবা চলতি ট্রেন থেকে তাকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। রেল সেতুটি নির্জন এবং অরক্ষিত যে কেউ চাইলে সেখানে অপরাধ ঘটাতে পারে।
রাজিয়ার এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পেয়েও শেষ বারের মতো তাকে দেখতে আসতে পারে নি পরিবার।
চট্টলার খবরের এই প্রতিবেদক রাজিয়ার বাবা মো. আমির উদ্দিন , মাতা জরিনা খাতুনের সাথে কথা বলেছে। বাবা আমির উদ্দিন বলেন, আমার ৩ ছেলে। ৩ মেয়ে। মেয়েদের মধ্যে রুজিনা সবার বড়। আমার অনেক আদরের মেয়ে ছিলো। আামি মাঠ থেকে আসলে আমাকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিতো। রাজিয়ার বয়স যখন ১৬ হঠাৎ করে তার কি যেন একটা রোগ ধরা পড়ে। গ্রাম্য ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি। কোন লাভ হয় নি। ধীরে ধীরে মেয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করে। অভাবের সংসারে মাঠে কামলার কাজ করে মেয়েটার ভালো চিকিৎসা করাতে পারিনি। মেয়েটা হয়ে গেলো পাগল। আমার পাগলি মেয়েটাকে একসময় বিয়ে দেই পাশের গ্রামের মহব্বত আলীর (৫৫) সাথে। মহব্বত আলী ভিক্ষা করে যা পেতো তা দিয়ে মিলেমিশে খেতো। সংসার চলতো।
আমির উদ্দিন আরও বলেন, দুই বছর ধরে সে নিখোঁজ ছিলো। শহর থেকে গ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা প্রতিটি আনাচে কানাচে ওকে খুঁজেছি। থানায় জিডি করেছি। মেয়েটা চট্টগ্রাম কিভাবে চলে গেলো। আমার মেয়ের এতো বোধশক্তি তো ছিলো না। বলতে বলতে একসময় চোখের পানি ছেড়ে দেন হতভাগ্য এই পিতা। বলে উঠেন আমার মেয়েটা মনে হয় ভালো হয়ে উঠেছিল। এমনই বাবা হয়েছি আদরের মেয়ের কপালে দু মুঠো মাটিও জুটলো না। বাবা হয়ে এই দুঃখ আমি কাকে বুঝাবো। আমি গরীব মানুষ। ট্যাহা পয়সা নাই। কিভাবে চট্টগ্রাম যাবো।
রাজিয়ার মা জরিনা খাতুন ঢুকরে কেঁদে উঠেন আর বলেন, আমার মেয়ে চট্টগ্রাম কিভাবে গেলো। আমার মেয়ে পাগল। আমার পাগলি মেয়েটার কি হয়ে গেলো। ছবিতে দেখলাম মেয়ের হাতগুলা ভাঙা। হাত ভাঙলো কেমনে। আমার মেয়েটারে আমার কাছে ফিরাই দেওয়া যায় না। আল্লাহ কেন আমার উপর নাখোশ হইলো। আমি এখন কার কাছে বিচার চাইতাম? আামার পাগলিটা বুঝি মার কাছে আর আইবো না।
রাজিয়ার রহস্যময় মৃত্য নিয়ে কথা হয় রেলওয়ে থানার ওসি নাজিম উদ্দিন ও সীতাকুণ্ড রেলওয়ে পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ এসআই খোরশেদ আলমের সাথে।
খোরশেদ আলম চট্টলার খবরকে জানান ঘটনার দিন খবর পেয়ে আমার লাশ উদ্ধার করি। ঘটনাস্থলে পিবিআইর টিম হাজির হয়। তারা প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করে। সুরতহাল রিপোর্টে তার শরীর বিভিন্নস্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এছাড়া মৃত্যুর আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে তার ভ্যাজাইনাল সোয়াব সংগ্রহ করা হয়েছে।
ওসি নাজিম উদ্দিন রুজিনার মৃত্যুর কারণ নিয়ে এখনই কোন মন্তব্য করতে চাই না। বিষয়টা আমরা তদন্ত করছি। আমরা একটি অপমৃত্যুর মামলা রেকর্ড করেছি।
এমএইচকে/নচ/চখ