chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

সরে যাক গোঁড়ামির অন্ধকার

আগত বছরের প্রত্যাশা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: হৈচৈ, টানাপড়েন, উত্তাপ সব ছিল বিদায়ী ২০২১ সালে। আসছে বছরটা কেমন যাবে এই ভাবনার মাঝে আশংকা থেকেই গেলো যে, করোনাভাইরাস যাচ্ছেনা। ওমিক্রন ঝড় বিপুল উদ্যোমে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী এবং এ কারণে আমাদের স্বস্তিতে থাকার কোনও কারণ নেই।

করোনার দাপট ছাড়াও ২০২১ সালকে মনে রাখা যাবে অনেক কারণে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী, বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর উৎসবের রঙ ছিল এবং নতুন উদ্যোমে জাতি শপথ নিয়েছে আগামী ৫০ বছরে দেশকে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেওয়ার। কিন্তু এ বছরই কুমিল্লায় শুরু হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে দুর্গাপূজার মন্ডপ ও প্যান্ডেল ও হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে তার ক্ষত মুছে যাওয়ার নয়। মনে রাখতে হবে বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের অতিথির উপস্থিতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সহ বেশ কয়েকটি জেলায় হেফাজতের সহিংস তাণ্ডবের কথা। মনে রাখতে হবে, আমাদের সমাজের সর্বস্তরে, শহরে বা গ্রামে বা অর্ধ শহর নামের মফস্বলে নারীর নিরাপত্তা যে কত স্বল্প, তার দৃষ্টান্ত নিয়মিত মিলছে এবং বছর শেষেও পর্যটন শহর কক্সবাজারে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন স্বামী-সন্তান সহ বেড়াতে যাওয়া এক নারী। এ বছরই সাড়ে তিন বছর পর আবার শিক্ষার্থীরা পথে নেমেছিল নিরাপদ সড়কের দাবিতে। সড়ক নিরাপদ হয়নি, পরিবহন নৈরাজ্য আরও বেড়েছে। বাসে হাফ ভাড়ার দাবিটি কিছুটা আদায় হয়েছে বলা যায়।

স্বীকার করা ভালো যে, কোনও আমলেই সংখ্যালঘুদের জীবন ও জীবিকার মৌলিক সমস্যাগুলো ঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি। ভোটের প্রয়োজনে এদের ব্যবহার করা হচ্ছে দাবার ঘুটির মতো। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনের কারণে বিএনপির কাছে সংখ্যালঘু সমাজ ন্যায়-বিচারের প্রত্যাশা করে না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরও যখন সাম্প্রদায়িক শক্তির অবস্থান মজবুত হয়, এমনভাবে সংখ্যালঘুদের মার খেতে হয়, তখন অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হয়।

সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই দাঙ্গা-হাঙ্গামার নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একজন হিন্দুর মনে ঢুকে গেছে অন্যসব নাগরিক অধিকারের চাইতে তার ব্যক্তি জীবন ও পারিবারিক জীবনের নিরাপত্তাই প্রধান। সমস্যাটা হলো নিরাপত্তার এই অভাববোধ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে কখনও বদলায়নি। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তার পুনরুদ্ধার প্রকল্প বাস্তবায়নের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল খন্দকার মুশতাক, জিয়া এবং এরশাদ তার রেশ এখনও কাটেনি। কারণ অনেক বিশ্লেষণ করা যায়, কিন্তু বাস্তবতা হলো সংখ্যালঘু সমাজের প্রাপ্য নিরাপত্তা বিধানে কোনও রাজনৈতিক দলই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।

সরকার বিরোধী পক্ষ নির্বাচন নিয়ে কত কথাই না বলছে। নিশ্চয়ই যৌক্তিক কারণও আছে কিছু কিছু কথায়। কিন্তু রাজনৈতিক গণতন্ত্র যে শুধু ভোটের বাদ্য বাজিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব না যেটা আমাদের রাজনীতি বুঝতে চায় না। স্বাধীনতা, সাম্য ও সম্প্রীতি- এই তিন নীতিকে সমাজে গভীরে ধারণ করতে না পারলে অনেক প্রকার উন্নয়ন হলেও দেশের অগ্রগতি হবে না। মুসলমান, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় বাংলাদেশে মিলেমিশে থাকবে পঞ্চাশ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এই ধারণাটি যেন এখন এক অলীক কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের গোঁড়ামির ধাক্কায় আজ বিপর্যস্ত সব শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ।

এই যে, গোঁড়ামির কথা বলছি সেটাই কেবল অগ্রসরমান। এসব গোঁড়ামি দেশের এক-এক অঞ্চলে এক-এক রকম। প্ল্যাটফর্ম ভিন্ন হলেও সামগ্রিকভাবে একটা পক্ষের মধ্যে ঐক্য বিরাজমান সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে। পৃথকীকরণ ও বিচ্ছিন্নতার চর্চা করে এরা এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যেন রাষ্ট্র সব সম্প্রদায়কে সমান সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করার জায়গায় না থাকে। প্রতিনিয়ত আমরা সম্প্রীতির কথা বলি ঠিকই, কিন্তু মনোজগতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ সম্পর্কে আমরা আসলে সন্দিহান।

নারীর নিরাপত্তাও ঠিক এমনই এক বিষয়। একের পর এক নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় আমরা চিন্তিত। একটা দেশের নারীদের ক্রমাগত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণ ও নির্যাতনের এমনসব ঘটনা ঘটছে যা একটার চেয়ে আরেকটা নির্মম। ফেনীতে মাদ্রাসা ছাত্রীকে পুড়িয়ে মারা হয়, বেগমগঞ্জে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নারীকে নির্যাতন করে পৈশাচিক আনন্দ করা হয়, কোথাও বা চলন্ত বাসে ধর্ষণ করা হয়। বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় আজও নৃশংসতার বলি হতে হচ্ছে মেয়েদের। একের পর এক নারকীয় নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসায় বারবার লজ্জায় মাথা হেট হচ্ছে। প্রশ্নের মুখে পড়ছে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা।

বিকৃতকাম মানসিকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে মূক ও বধির, এমনকি মানসিক ভারসাম্যহীন নারীরাও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এখানেও সমস্যা অনেক গভীরে। নারীর সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয়, এই শিক্ষাটুকুই নেই আমাদের।  বহু ক্ষেত্রে সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যেও বিকৃতকামের প্রবেশ ঘটে। আর আমাদের এই সমাজ ধর্ষককে সাদরে গ্রহণ করলেও ধর্ষণের শিকার নারীকে তো ততটা সানন্দে গ্রহণ করে না, প্রতি পদে লড়াই সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় তাদের। বেশিরভাগই সেই লড়াইয়ে হেরে যান।

প্রতিটি স্তরে সুস্থ-নিরাপদ জীবনের অধিকার সব নাগরিকের। সেই দর্শন থেকেই রাষ্ট্র যদি সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল হয়, তবে কমবে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতা। তেমনই রাষ্ট্র যদি লৈঙ্গিক বৈষম্যকে সব কাজে নিরুৎসাহিত করে তবেই কমবে নারীর প্রতি সহিংসতা। নতুন বছরে প্রত্যাশা এটুকুই – গোঁড়ামির অন্ধকার সরে যাক, আলো আসুক।

লেখক: সাংবাদিক  

এমকে/চখ