chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

এরদোয়ানের অর্থনীতিতে ডুবছে তুরস্ক

ডেস্ক নিউজ: তুরস্কের অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়েছে। সেদেশে মুদ্রাস্ফীতি উচ্চ এবং বাড়ন্ত, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেয়েছে, বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ কমে গেছে বা বাজারে আর পাওয়া যাচ্ছে না এবং নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো দরিদ্র হয়ে পড়ছে। দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ২০১৩ সালের ১২,৬০০ মার্কিন ডলার থেকে ২০২০ সালে ৮,৫০০ ডলারে নেমে এসেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে তুরস্কের ৮ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এই দশকের সিংহভাগ সময় এক ম্লান অর্থনৈতিক সম্ভাবনার মুখোমুখি।

তুরস্ক ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ— তবে দেশটির এমন পরিস্থিতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের যতটুকু মনোযোগ পাওয়ার কথা ততটুকু পাচ্ছে না। তুরস্কের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের চারটি দেশের স্থল বা জলসীমানা রয়েছে। তুরস্ক ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং এই জোটে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক বাহিনীর মালিক। দেশটির সংকট শুধু তার অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এর বাইরেও এর গুরুত্ব রয়েছে।

তুরস্কের সমস্যাগুলো প্রায় সম্পূর্ণটাই নিজেদের তৈরি। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক বিরোধীদের উত্থান দমন করতে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তঃসারশূন্য এবং জনগণের মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট করতে বছরের পর বছর অতিবাহিত করেছেন। বিগত বছরগুলোর শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভোলাপমেন্ট পার্টি (একেপি) ২০০২ সালের পর প্রতিটি নির্বাচনে জয় পেয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির ফলে সেই সমর্থন বর্তমানে মারাত্মক হ্রাস পেয়েছে।

রাজনৈতিকভাবে এরদোগান সরকার ধর্মীয় রাষ্ট্রের ধারণাকে সমর্থন করে আসছে, যদিও তুরস্কের সংবিধান সেদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাধ্যতামূলক করেছে। এছাড়া ২০১৬ সালে একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর থেকে সেদেশে সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভিন্নমতকে নির্মমভাবে দমন করে আসছে সরকার।

রাজনৈতিক অবস্থার চেয়ে অর্থনৈতিক অবস্থা এখন আরও খারাপ। গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হতে শুরু করে, তখন এরদোগান সরকার বৃহৎ পরিসরে অবকাঠামোগত বিনিয়োগ শুরু করে এবং সুদের হার কম রাখতে ব্যাংকগুলোকে উৎসাহ দেয়। কিন্তু যেহেতু বিশাল এই ব্যয় বাহ্যিক উৎস থেকে অর্থায়ন করা হয়েছিল তাই তা দেশের মুদ্রাস্ফীতিতে চাপ সৃষ্টি করে । ২০১৭ সালে তুরস্কে মুদ্রাস্ফীতির হার দুই অঙ্কে পৌঁছেছিল এবং পরে তা আরও বেড়েছে।

এভাবে করোনাভাইরাস মহামারির আগে থেকেই তুরস্কের অর্থনীতি গভীর সমস্যায় ছিল। মহামারি দেশটির অর্থনীতিতে কঠোর আঘাত হানে। যদিও মহামারির সময় আগ্রাসী উদ্দীপনা প্যাকেজ বা উদ্দীপক ব্যবস্থা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পুনরায় শুরু করতে সক্ষম করে, তবে সামষ্ঠিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এ বছরের শেষ প্রান্তিকে , তুরস্কে মুদ্রাস্ফীতির হার ২১ শতাংশ। কিন্তু বহু বিশ্লেষক বলছেন, মুদ্রাস্ফীতির প্রকৃত হার আরও অনেক বেশি। বাজার পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে তুরস্কের নাগরিকদের বড় একটি অংশের প্রকৃত আয় (মুদ্রাস্ফীতি-সামঞ্জস্যতার কারণে) মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে।

বিষয়টিকে আরও খারাপ করে দিতে এরদোগান দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদের হার কম রাখার জন্য চাপ দিয়ে আসছেন। কারণ এরদোগান একটি সেকেল তত্ত্ব আঁকড়ে ধরে বসে আছেন যে— উচ্চ সুদ হারের কারণে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। কিন্তু যেকোনো বিশ্বাসযোগ্য অর্থনীতিবিদই আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন যে, মুদ্রাস্ফীতির আগুন ঠাণ্ডা করতে সুদের হার নিম্ন নয়, বরং উচ্চ রাখা উচিত। কিন্তু এরদোগান তার বিকৃত বিশ্বাসে অটল। তিনি তার বিশ্বাসে এতটাই আস্থা রাখেন, দেশের অর্থনীতি তার তত্ত্ব মতে চলছে এটা নিশ্চিত রাখতে গত দুই বছরে তিনবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পরিবর্তন করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর গত ১৬ ডিসেম্বর সুদের হার আরও এক দফা কমিয়ে ১৪ শতাংশ করেছেন, এতে প্রকৃত সুদের হার স্থির হয়েছে ঋণাত্মক সাত শতাংশ।

এছাড়া সরকারের বহু উদ্দীপনা নীতি প্রকৃত উৎপাদন বৃদ্ধি না করে বরং মুদ্রাস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করেছে, ব্যবসায় মূলধন হ্রাস করেছে এবং তুর্কি মুদ্রা লিরার ব্যাপক অবচয় ঘটিয়েছে। চলতি বছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে লিরা ৪৫ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে। রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পাওয়ায় চলতি বছরের মার্চে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট রিজার্ভ দায় ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পত্তির মূল্য ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে নেমে গেছে।

এরদোগান অপ্রচলিত অর্থনৈতিক নীতি আঁকড়ে ধরে রাখার কারণে তার দেশে পণ্যের ঘাটতি তীব্র হয়ে উঠেছে। যদিও কিছু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর ক্রমবর্ধমান ঘাটতি মূলত রাজস্ব ঘাটতি বাড়িয়ে তুলছে। যার ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ আরও বাড়ছে।

দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির কারণে ২০২১ সালে প্রকৃত মজুরি ডলারের হিসেবে ২৭ শতাংশ কমে গেছে। ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় জীবনযাত্রার মানের অবনতি হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে সরকার ৫০ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি বাধ্যতামূলক করেছে, যা ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। কিন্তু সরকারের এমন সিদ্ধান্ত মূল্যস্ফীতির আগুন তো কমাবে না, বরং তাতে ঘি ঢালার শামিল।

যদি তুর্কি সরকার আর্থিক নীতি এখনই কঠোর করে এবং অন্যান্য সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজস্ব ঘাটতি হ্রাস ও অর্থনীতিতে চাপ কমাতে মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উঠিয়ে নেয় (বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের উপর থেকে) তাহলে এখনও অর্থনৈতিক রক্তপাত বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু যদি এরদোগান তার বর্তমান তত্ত্বে অটল থাকেন, তাহলে তুর্কির অর্থনীতি ও সেদেশের পরিবারগুলোর অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হয়ে পড়বে। কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশের অবস্থা উপেক্ষা করা বাকিদের জন্য অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।

লেখক: বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রাক্তন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্সের সিনিয়র রিসার্চ প্রফেসর এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো।

প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত

ভাষান্তর: আতিকুল ইসলাম ইমন

জেএইচ/চখ

এই বিভাগের আরও খবর