chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

‘অভাব’ই শ্রমে টানছে শিশুদের

রকিব কামাল: ১২ বছরের সাইফুল ইসলাম সোহাগ কাজ করেন নগরের মুরাদপুরের একটি গাড়ি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানে। রিকশাচালক বাবার রোজগারের আয় কম, তাই তৃতীয় শ্রেণির পরই পড়াশোনার পাঠ চুকাতে হয়েছে তাকে।

সোমবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুরে সড়কের পাশে কোনো রকম সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াই ওয়েল্ডিং মেশিন দিয়ে কাজ করতে দেখা গেল সোহাগকে।

তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বরুড়া থানার ভাউকসার বাজার হলেও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। নগরের মুরাদপুর এলাকার পাশের একটি বস্তিতে ভাড়া থাকে। হুমায়ন কবিরের দুই সন্তানের মধ্যে সাইফুল বড়।

সাইফুলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্কুলের নামও ঠিক মতো বলতে পারেনি। পরনে ময়লা কাপড়। সে চট্টলার খবরকে বলেন, আব্বা শহরে রিকশা চালায়। বাসায় ছোট বোন আছে। আব্বার টাকা দিয়ে সংসার চলে না। তাই মামা দোকানে কাজে লাগিয়ে দিছে।

দুপুর ১২ টা। নগরের জিইসির মোড়ের বাস স্টেপজে এসে থামে যাত্রীবাগী বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাস। চারদিকে গাড়ির হর্নের তীব্র আওয়াজের মধ্যেও কানে এসে বাজে ওই বাসের হেলপার রাব্বির আওয়াজ গলা ছেড়ে দেওয়ানহাট, আগ্রাবাদ, বারেক বিল্ডিং রোডের যাত্রীদের আকৃষ্ট করছে।

সে দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরিতে বিআরটিএর লোকাল বাসে হেলপারের কাজ শুরু করে রাব্বি। তার গ্রামের চট্টগ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপ। রাব্বিরা দুই ভাই ও তিন বোন। ছোট বেলায় বাবা মারা গেছেন। বাসায় মা অসুস্থ মা। বাধ্য হয়ে ১৩ বছর বয়সে রাব্বিকে পরিবারের বোঝা বইতে হচ্ছে। তার স্বপ্ন একদিন বড় বাসের চালক হবে।

সাইফুল ও রাব্বির মতো হাজারো শিশুকে বই আর স্কুল ভুলে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। অনিশ্চিয়তার দোলায় দুলছে তাদের ভবিষ্যত।

শ্রম আইন অনুযায়ী, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা নিষেধ করা হয়েছে। আইনে শিশুদের দিয়ে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করা যাবে না। ১৪ থেকে ১৮ বছরের শিশুরা হালকা কাজ করতে পারবে। কেউ শিশু শ্রমিক নিয়োগ দিলে পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। কম বয়সী শিশুদের শ্রম একেবারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে এই আইন অমান্য করে প্রকাশ্যে কাজ করে চলেছেন শিশুরা। এতে প্রায় সময় ঘটছে প্রাণহানির মতো ঘটনা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে শিশুরা জাহাজভাঙা শিল্প, ঝালাই কারখানা, পুরান যন্ত্রপাতির মেরামতের প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, বাস-টেম্পুর চালক থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হারহামেশাই করে যাচ্ছে। এসব কাজে শিশু শ্রমিকদের দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি সময়ও কাজ করতে হচ্ছে। এরমধ্যে বিভিন্ন নিপীড়নও সহ্য করতে হয়। কাজ করার সময় দেওয়া হয় না পর্যাপ্ত সুরক্ষাসামগ্রী। করোনা মহামারীর কারণে এ সংকট আরও ব্যাপক আকারে রুপ নিয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঘাসফুল। সংস্থাটির আউট ওব স্কুল চিলড্রেন প্রোগ্রামের সমন্বয়কারী সিরাজুল ইসলাম চট্টলার খবরকে বলেন, প্রকতৃপক্ষে নগরে কতজন শিশু শ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ পেশাতে সম্পৃক্ত রয়েছেন এরকম কোনো তথ্য কারো কাছে নেই। করোনা মহামারীর প্রেক্ষাপটে এ পরিস্থিতি আরও নাজুক আকার ধারণ করেছে। আমাদের এক তথ্যে উঠে এসেছে কেবল পরিবহন সেক্টরে ৩ হাজারের বেশি শিশু শ্রমিক কাজ করছে।

তিনি আরো বলেন, সার্বিকভাবে এ সংখ্যা ৩৫ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। আমরা চেষ্টা করছি অভিভাবকদের এসব বিষয়ে সচেতন করতে। তবে বাধ্য হয়ে এসব পরিবারের শিশুদের জীবিকার জন্য কাজে নামতে হচ্ছে।

শিশুশ্রম কমিয়ে আনতে সরকারি ও বেরসরকারি পর্যায়ে সমন্বয়ের তাগিদ দিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমাজতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক পারভীন সুলতান। তিনি চট্টলার খবরকে বলেন, এসব শিশু একটা সময় স্কুলে ভর্তি হলেও পারিবারিক অনটনের কারণে পড়ালেখা বন্ধ করে দিচ্ছে। সামাজিক ও আর্থিক কারণে পিতামাতারাও ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা নিয়ে উদাসীন থাকে। এসব শিশুদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু এনজিও কাজ করছে। তবে সমন্বয়ের অভাবে রয়েছে। আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এক্ষেত্রে সরকারকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে বিভাগীয় শ্রম দপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দীনকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি।

আরকে/এমকে/চখ

এই বিভাগের আরও খবর