![কর্ণফুলীতে বালু উত্তোলনের মহোৎসব](https://chattolarkhabor.com/wp-content/uploads/2021/11/কর্ণফুলীতে-বালু-উত্তোলনের-মহোৎসব.jpg)
কর্ণফুলীতে বালু উত্তোলনের মহোৎসব
রকিব কামাল: কালো বর্জ্য, বিষাক্ত পলিথিন ও পলিমাটি জমে দখল আর দূষণে তিলে তিলে শেষ হতে বসেছে চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদী। এ নদীর গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ চট্টগ্রাম নগরীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যার ফলে নানা কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে কর্ণফুলী নদী। নদীটি সংযুক্ত করেছে আরও পাঁচটি নদীকে। তবে চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এ নদীকে গিলে খেতে দুপারে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বালুর মহাল। নদীর বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশাল আকৃতির বালু বহনকারী বোট ও ড্রেজার মেশিন।
বালু মহালের ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক বালুর মহালে দিনে ৪০ হাজারের বেশি ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। জোয়ার ভাটাকে কাজে লাগিয়ে দিনে ও রাতে দুবার বালু উত্তোলন করা হয়। ব্যবসায়ীদের মতে, নদীর কালুরঘাট অংশ থেকে নতুন ব্রিজ এলাকা পর্যন্ত শতাধিক ছোট বড় বালুর মহাল রয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বালুর মহলের ইজারা দেওয়া হলেও, এক্ষেত্রে কী পরিমাণ বালু উত্তোলন করা যাবে তার কোনো হিসেব নেই। এমনকি ইজারার শর্তও মানছেন না অনেকে।
![কর্ণফুলীতে বালু উত্তোলনের মহোৎসব](https://chattolarkhabor.com/wp-content/uploads/2021/11/কর্ণফুলীতে-বালু-উত্তোলনের-মহোৎসব-1.jpg)
পরিবেশবাদীরা বলছেন, এভাবে বালু উত্তোলন চলতে থাকলে নদীর পাশাপাশি জলজ প্রাণির অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে। জানতে চাইলে পরিবেশবিদ ও কর্ণফুলী নদী বিশেষজ্ঞ ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস চট্টলার খবরকে বলেন, কর্ণফুলী নদী থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বালু তোলায় নদীর সেডিমেন্টেশন হচ্ছে এবং নদীর স্বাভাবিক বাস্তুতান্তিকথা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে নদীর পানি দিন দিন ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। জলজ প্রাণি ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাধ্য হয়ে মৎস্যজীবী ও জেলেরা পেশা বদল করছেন। নদীর ভারসাম্য হারিয়ে বিভিন্ন জায়গায় জেগে উঠছে ডুবন্ত চর।
এক প্রশ্নের জবাবে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, নদীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তার ওপর নানাভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে। তার দেহকে ভোগ করে ব্যবসার কাজে লাগিয়ে মাস্তান ও সন্ত্রাসীদের হাতে বালু উত্তোলনের ইজারা দেওয়া হচ্ছে। অথচ জেলা প্রশাসন ও বন্দর বরাবরই এ বিষয়ে পাশ কেটে গিয়েছে। নদীর প্রয়োজন অনুসারে ড্রেজিং করার কথা থাকলেও, বন্দরের ইচ্ছে মতো ড্রেজিং করা হয়েছে। বন্দর ও জেলা প্রশাসন সমানতালে এই অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এই নদীটি সব দিক থেকে জাতীয় নদীর মর্যাদা পেলেও সংবেদনশীল ও তদারকির অভাবে মরে যেতে বসেছে। কর্ণফুলীকে বাদ দিয়ে কেবল হালদা হালদা করে চিৎকার করলে হবে না। ঢাকা থেকে কবে নির্দেশনা আসবে সে দিকে সবাই তাকিয়ে থাকেন। নদীকে বাঁচাতে হলে এখনই এসব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে।
জানা গেছে, জেলা প্রশানের পক্ষ থেকে প্রতি বছর দরপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বালু মহালের ইজারা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে এই বালু মহালের সংখ্যা ছিল ৯১টি। বালু উত্তোলনের সাথে সম্পৃক্ত এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টলার খবরকে বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইজারা নেওয়ার পর অনেকেই বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাব লিজের মাধ্যমে বালু উত্তোলনের কাজ সারেন। এরা সুবিধা মতো বিভিন্ন ব্লকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করে। দরপত্রের শর্তাবলীতে এই ধরনের নিয়ম নেই। বিষয়টি তদারকি করলে ইজারা দেওয়া প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যেতে পারে।
কর্ণফুলীর কালুরঘাট ব্রিজের অংশে বালুর মহালের ইজারা নিয়েছে মাওয়া এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির অধীনে দুটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলছে বালু উত্তোলন। সেখানে ববী সাব ও কামাল সাব ইজারা নিয়ে বালু উত্তোলনের কাজ করছে। তবে কোম্পানাটির একটি ব্লক চৌধুরী গ্রুপ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে সাব লিজের মাধ্যমে বালু উত্তোলনের দায়িত্ব দিয়েছে। তারা নিজস্ব ড্রেজার শ্রমিক দিয়ে বালু উত্তোলনের কাজ সারছে। সেখানে দায়িত্ব পালন করা এক কর্মচারী চট্টলার খবরকে বলেন, নয়টি ড্রেজারের সহায়তায় দিনে ও রাতে ৪০ হাজারের বেশি ঘনফুট বালু তোলা হয়। দিনে ১৫ থেকে ১৭ ট্রাক বালু চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। একটি ট্রাকে তিন থেকে সাড়ে তিনশো ঘনফুট বালু বহন করা যায়।
চৌধুরী গ্রুপের এক কর্মচারী চট্টলার খবরকে বলেন, ইজারার বিষয়টি আমাদের জানা নেই। আমরা সাব লিজ নিয়ে নিজস্ব গাড়ি, শ্রমিক ড্রেজারের সহায়তায় বালু তুলে বিক্রি করে থাকি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন ডেভেলপারসহ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বালু সরবরাহ করা হয়।
সোহেল নামে বালু মহালের অফিসে দায়িত্বে থাকা আরেক কর্মচারী বলেন, করোনার কারণে বিক্রি কিছুটা কমে এসেছে। কর্ণফুলী ঘাটের চেয়ে নতুন ব্রিজ এলাকায় বালুর বিক্রি বেড়েছে। এখানে অনেকে সাব লিজের মাধ্যমে বালুর মহাল চালাচ্ছে।
তবে সাব লিজের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মাওয়া এন্টারপ্রাইজের ইজারাদার হাজী মোহাম্মদ আলম। তিনি চট্টলার খবরকে বলেন, আমি কাউকে সাব লিজ দেইনি। নিজের প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সাব লিজ কেনো দিব। প্রতি বছর ব্যবসার জন্য সরকারকে কোটি কোটি টাকা ভ্যাট দিতে হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে দেখেন অন্য ইজারাদারা সাব লিজ দিয়ে থাকতে পারে।
এদিকে গত শনিবার (১৩ নভেম্বর) কর্ণফুলী মৎস্য সম্পদ রক্ষা কমিটির নেতৃবৃন্দ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। এসময় কর্ণফুলী নদী রক্ষায় অবৈধ বালু উত্তোলন, দখল ও মৎস্য সম্পদ ধ্বংস বন্ধ করার আহ্বান আহ্বান জানান সুজন।
সুজন বলেন, অপরিকল্পিতভাবে কর্ণফুলী থেকে নিয়মিত বালু উত্তোলন করায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। নদীর দুইপাশে ভাঙনের কারণে বিলীন হতে যাচ্ছে। বন্দরের পুরাতন জেটিগুলো প্রায় ভরাটের পথে। নদীর দু’পাড়ে গড়ে উঠেছে শত শত অবৈধ স্থাপনা, প্রায় পাঁচ শতাধিক শিল্প, কল-কারখানা, অসংখ্য জাহাজ নৌযানের বিষাক্ত বর্জ্যে। যে কারণে কালুরঘাট এবং শাহ আমানত সেতু যে কোনো সময় হুমকির মুখে পড়তে পারে। পরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধি করতে হবে। নদীর স্বাভাবিক গতিধারা বজায় রাখতে সচেতন মহলকে এগিয়ে আসার পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান চট্টলার খবরকে বলেন, কর্ণফুলী রক্ষার দায়িত্ব সবার। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি জলজ প্রাণি থেকে শুরু করে নদীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ নিশ্চিত করতে। কালুরঘাট ও নতুন ব্রিজ এলাকায় বালু মহালের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে কথা বলব। কোনো অনিয়ম পেলে সেটিও বিবেচনায় এনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরকে/এমআই