
আমার ছবি তুলে কী হবে ?
নিজস্ব প্রতিবেদক: হানিফের বাড়িতে সকাল থেকেই আসছিলেন গণমাধ্যম কর্মীরা। অনেকে ছবি তোলার চেষ্টা করছিলেন। হানিফের মা হোসনে আরা বেগম তখন তাদের বলছিলেন, আমার ছবি তুলে কী হবে ? এক ছেলে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছে, আরেক ছেলে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। আমি কী এ হত্যার বিচাই পাব তোমাদের কাছে, তোমাদের সরকার কী এ বিচার করবে ? প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি এ হত্যার বিচার চাই। মৃত্যুর বদলে, মৃত্যু চাই ওদের।
বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন হোসনে আরা। তার কান্না শব্দে আশেপাশের মানুষের চোখ ভিজে আসে। আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশীরা ঘিরে রেখেছিলেন তাকে। কিন্তু সান্ত্বনাটুকু দেওয়ার মতো কোনো কথা আসছিল না কারও মুখেই।
তার পাশে কাঁদছিলেন হানিফের বাবা মো. আলাউদ্দীন খান। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার মধ্যেই চোখের জল গড়িয়ে দাঁড়ি ভিজে আসে তার। ছুরিকাঘাতে ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যু আর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছেলের কথা মনে করতেই বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন মা হোসনে আরা বেগম। ছেলেকে হারিয়ে বিপর্যস্ত, হতবাক পরিবারে নেমে এসেছ শোকের ছায়া। স্বজনেরা শোকে স্তব্ধ।
হোসনে আরা চট্টলার খবরের সঙ্গে কথা বলতেই গিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও কান্না ধরে রাখতে পারেননি। তিনি বলেন, আমি কিচ্ছু চাই না। অনেক কষ্টে আমি ছেলেগুলোকে মানুষ করেছি। না খেয়ে খাওয়াছি। আমিতো কান্না করতে পারছি না। কে আমাকে এ সুখ দিলো? আমি বিচার চাই, সত্যি বিচার চাই। ওরা আমার সর্বনাশ করেছে, রাস্তায় নামাই দিছে। আমি খুনিদের ফাঁসি চাই।
গতকাল বিকেলে নগরের খুলশী থানার আমবাগান এলাকায় তরুণ সংঘের মাঠে কয়েকজন স্থানীয় যুবকের ছুরিকাঘাতে মারা যান মো. হানিফ (২২)। হানিফ পেশায় একজন দিনমজুরী ছিলেন। তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে গুরুতর আহত হন হানিফের ভাই মো. অনিক (২৪)। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি আছেন।
রিকশা চালক মো. আলাউদ্দীন খান ও হোসনে আরা বেগমের পাঁচ মেয়ে, তিন ছেলে। খুন হওয়া হানিফ পরিবারের সেজো এবং আহত অনিক মেজো ছেলে। দেড় মাস আগে অনিক দুই যমজ সন্তানের পিতা হন। তার সুস্থতার অপেক্ষায় পাগলপ্রায় তার স্ত্রী।
মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) দুপুরে নগরের আমবাগানে এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঘটনাস্থল তরুণ সংঘের মাঠের এক পাশে হানিফকে ছুরিকাঘাত করার স্থানে রক্তের দাগ পড়ে আছে। হানিফের বাসায় আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয়দের জটলা। পরিবারের সদস্যরা শোকে মুহ্যমান। তারা কোনোভাবেই হানিফের মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না।
ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পত্রিকায় পড়ছেন বোন
ঝুপড়ি ঘরের এক পাশে উঠানে পত্রিকার পাতায় ভাই হানিফের হত্যাকাণ্ডের খবর পড়ছিলেন মেজো বোন লাকী আক্তার। তার পড়ার শব্দে কয়েকজন তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেন। লাকী চট্টলার খবরক জানান, গত শুক্রবার এশার নামাজের সময় রেলওয়ের কর্মকর্তা ফারুক সাহেবের ছেলের সাথে ভান্ডারী নামে এক ব্যক্তির বাড়াবাড়ি হয়। বাড়াবাড়ির পর ভান্ডারী রেলওয়ের কর্মকর্তাকে মারধর করেন। ওই সময় হানিফের বড় ভাই জয়নাল আবেদীনসহ কয়েকজন মিলে বিষয়টি থামানোর চেষ্টা করেন। ওই সময় জয়নালকে মারধর করা হয়।
ওই দিন বিষয়টি সুরাহা হলেও গতকাল বিকেলে মাঠে খেলতে যাওয়ার সময় সোহেলের বাবা, ভান্ডারী ছেলে ছাড়াও হাসান, সোহাগ, নুর নবী, মর্জিয়াসহ কয়েকজন যুবক নির্মমভাবে হানিফকে ছুরিকাঘাত করে। আমি চেষ্টা করেও ধরতে পারি নাই। আমার মা বাধা দিতে গেলে তাকে সোহেল লাথি মারে। পরে আমার ভাই অনিক আসলেও তাকে ছুরিকাঘাত করে।
খেলার মাঠে ঝড়ল হানিফের প্রাণ
প্রতিদিন বিকেলে তরুণ সংঘের মাঠে খেলতেন আসতেন হানিফ। এলাকায় বয়স্ক থেকে তরুণদের কাছে অত্যন্ত ভ্রদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিল তার। সকলের সাথে মিলে মিশে থাকতেন। গতকাল সেই মাঠে খেলতে গিয়ে কয়েকজন যুবকের ছুরিকাঘাতে ঝড়ল তার প্রাণ। ভাইকে বাঁচাতে ঝড়েছে ভাইয়ের রক্ত।
এদিকে হানিফের মৃত্যুর ঘটনায় তার বড় ভাই জয়নাল আবেদীন বাদী হয়ে খুলশী থানায় আটজনের নাম উল্লেখ করে এবং কয়েকজনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহীনুজ্জামান চট্টলার খবরকে বলেন, হানিফের খুনের ঘটনায় নুরুল ইসলাম ও রোকসানা আক্তার নামে দুই আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
আরকে/চখ