chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

এমন মৃত্যু আর কত দেখবে নগরবাসী?

দায় নিচ্ছে না চসিক-সিডিএ

রকিব কামাল: চোখের চিকিৎসা শেষে চশমা নিয়ে মামার সঙ্গে বাসায় ফিরছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী সেহেরুন মাহমুদ সাদিয়া (১৯)। রাতের অন্ধকারে চলতি পথে হঠাৎ করেই পা পিছলে পড়ে যান নালায়। ভাগনি পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বাঁচাতে ঝাঁপ দেন মামাও। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সাদিয়া তলিয়ে যায় নালার গভীরে।

প্রায় পাঁচ ঘণ্টা অভিযানের পর ৭০ ফুট গভীর থেকে এক টন আবর্জনা সরিয়ে মেলে সাদিয়ার নিথর দেহ। ঘটনাস্থল আগ্রাবাদ বাদামতলীতে তখন জড়ো হয়ে পড়ে হাজারও মানুষ। সাদিয়ার পরিবারের আহাজারিতে শোকের ছায়া নেমে আসে সেখানে।

সন্তানের এমন আকস্মিক মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না সাদিয়ার পরিবার। তার সহপাঠিরাও মেনে নিতে পারছে না এমন মৃত্যু। সবার প্রশ্ন, নালায় পড়ে এমন মৃত্যু আর কত দেখবে নগরবাসী?

এমন মৃত্যু আর কত দেখবে নগরবাসী
খালের পাশে নেই কোনো সর্তকর্তামূলক চিহ্ন। বৃষ্টিতে হাঁটু পরিমাণ পানিতে তলিয়ে যায় সড়ক। ফলে যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। ছবিটি নগরীর কমার্স কলেজ রোড ২নং মোগলটুলী খাল থেকে তোলা। আলোকচিত্রী – এম ফয়সাল এলাহী

শুধু সাদিয়া নয়, এর আগে গত ২৫ আগস্ট মুরাদপুর এলাকায় রাস্তায় জমে থাকা পানি দিয়ে হাঁটার সময় চশমাখালে পড়ে যান সালেহ আহমেদ (৫০) নামে এক সবজি বিক্রেতা। এখনও তার খোঁজ মেলেনি। গত চার মাসে নগরীতে এমন ঘটনায় চার জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব মৃত্যুর পর অরক্ষিত খাল ও নালার পাশে কার্যত কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো সেবা সংস্থাগুলো দায় এড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এক সংস্থা আরেক সংস্থার উপর দায় চাপাচ্ছে।

এমন মৃত্যু আর কত দেখবে নগরবাসী
খালের পাশে নেই কোনো সর্তকর্তামূলক চিহ্ন। ফলে যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। ছবিটি নগরীর মোগলটুলী ইয়াছিন আলী গলির সামনে থেকে তোলা। আলোকচিত্রী – এম ফয়সাল এলাহী

বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) চসিক ষষ্ঠ পরিষদের অষ্টম সাধারণ সভায় মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছেন, সরকারের মেগাপ্রকল্পসহ যে সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে সেগুলোতে সমন্বয়হীনতার কারণে নাগরিক দুর্ভোগ ও সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব সমস্যা নিরসনে সরকারের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মেয়র।

তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে পরপর যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে তাতে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে কষ্ট পেলেও তা লাঘবে আমার ক্ষমতা খুবই সীমিত। কারণ প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান বা নির্বাহকারক প্রতিনিধিগণ সরকারী নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও তারা দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা প্রদানের আওতা বহির্ভূত।

তিনি আরো বলেন, যেখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে ঐ স্থানগুলোতে নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় প্রতিনিয়তই দুঃখজনক দুর্ঘটনা ঘটছে। অথচ এর জন্য সিডিএর একজন ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী চসিকের প্রতি দোষারোপ করে যে সকল বিদ্বেষমূলক উক্তি গণমাধ্যমে প্রকাশ করছেন তা আন্ত:সংস্থা (সিডিএ ও চসিক) বিরোধ সৃষ্টি করার অপপ্রয়াস বলে মনে করি। এ কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। তাই প্রশ্ন জাগে ঐ প্রকৌশলী কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।

অপরদিকে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ উল্টো চসিকের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে দায় ঘুচিয়েছেন। আবার সেবা সংস্থার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করার কথা বলছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।

এলিভেটেভ এক্সপ্রেসওয়ে এবং জলাবদ্ধতা নিরসনসহ মেগা প্রকল্পের কাজ সিডিএ করায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীর মৃত্যুর জন্য সংস্থাটিকে দায়ী করছেন মেয়র।

বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে নগরের বেশ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে চোখে পড়ে ভয়াবহ চিত্র। আগ্রাবাদ, মুরাদপুর, হালিশহরসহ নগরের অধিকাংশ এলাকায় উন্মুক্ত নালার পাশ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে হাঁটতে হচ্ছে পথচারীদের। এসব এলাকায় প্রায় সময়ে ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।

পাহারা দিয়ে স্ল্যাব রক্ষা

নগরের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের সুপারিওয়ালা পাড়া থেকে বউবাজার পর্যন্ত এলাকায় পানি নিষ্কাশনের জন্য স্ল্যাব বসানো হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হলে পানির স্রোতে সেই স্ল্যাব ভেসে কয়েক ফুট দূরে চলে যায়। তখন উন্মুক্ত নালার স্থানে বাঁশ দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন স্থানীয়রা। অনেক সময় নালার পাশে পাহারা দেন বাসিন্দারা।

এমন মৃত্যু আর কত দেখবে নগরবাসী
নগরীর সুপারিওয়ালা এলাকায় ড্রেন কেটে স্ল্যাব বসানো হয়েছে। বৃষ্টি হলে পানির স্রোতে এসব স্ল্যাব ভেসে যায় কয়েক ফিট দূরে। দুর্ঘটনা এড়াতে পথচারীরা স্ল্যাবের পাশে পাহারা দেন। ঝুঁকি নিয়ে এসব স্ল্যাব মাড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে পথচারীদের। আলোকচিত্রী – এম ফয়সাল এলাহী

ওই এলাকায় যাওয়ার পর ভু্ক্তভোগীদের মুখে উঠে আসে জলাবদ্ধতায় নাকাল হওয়ার বিষয়টি। সাত বছর ধরে মেসার্স সৌরভ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসে কাজ করছেন শ্যামল দাশ। তিনি চট্টলার খবরকে বলেন, আড়াই বছর আগে নালা পরিষ্কার করা হয়েছিল। যার কারণে পানির স্রোতের চাপে স্ল্যাব সরে পড়ে। গত বছর একজন নালায় পড়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে সে বেঁচে যায়। কয়েকদিন আগে একটি কুকুর পড়ে মারা যায়। এখানকার মানুষের কাছে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

আরেক বাসিন্দা মো. আলী বলেন, চোখের সামনে ১৫ জন মানুষকে পড়ে যেতে দেখেছি। বৃষ্টি শুরু হলে মানুষকে পাহারা দিয়ে স্ল্যাব রক্ষা করতে হচ্ছে।

প্রকৌশলীদের বিভক্তিতে ২০ বছরেও হয়নি খালের সংস্কার।

নগরের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মোগলটুলী খাল মিশেছে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে। এই ওয়ার্ডের ইয়াছিন আলী গলি ও কমার্স কলেজের ছাত্রী নিবাসের পাশে দেখা গেল বেশ কয়েক ফুটের উন্মুক্ত নালা। সেই সড়কের পাশ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে হাঁটছে শিশুরাও।

এমন মৃত্যু আর কত দেখবে নগরবাসী
নগরীর বেশির ভাগ নালা ও খালের পাশে নেই স্ল্যাব। বৃষ্টিতে ফুটপাত ও সড়ক একাকার হয়ে যায়। অরক্ষিত এসব নালা-খালের পাশ ঘেঁষে হাঁটতে হচ্ছে পথচারীদের। ছবিটি নগরীর কমার্স কলেজ ছাত্রী নিবাসের পাশে ২নং মোগলটুলী খাল থেকে তোলা। আলোকচিত্রী – এম ফয়সাল এলাহী

মনিরুল হক মুন্না নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, নির্বাচনের আগে উনারা অনেক প্রতিশ্রতি দেন। কিন্তু এলাকায় এসে মানুষের দুর্ভোগ দেখেন না। কত ছাত্রছাত্রী, গাড়ি এখানে উল্টে পড়ে গেছে। এলাকাবাসীর দাবির মুখে কয়েকজন প্রকৌশলী এখানে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে চেয়েছিল। কয়েকদিন পর আরেক প্রকৌশলী এসে নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রয়োজন নেই বলে জানান। রাস্তা উুঁচ করা হয়েছে, কিন্তু বিশ বছরে এই নালায় কোনো সংস্কারের হাত পড়েনি।

ফিতা দিয়ে দায়িত্ব সারছে চসিক

নগরের মুরাদপুরে গিয়ে দেখা যায়, নালায় পড়ে সালেহ আহমদ নিখোঁজের এক মাসেরও বেশি সময় পার হতে চললেও উন্মুক্ত খালের পাশে স্থায়ীভাবে কোনা নিরাপত্তা বেষ্টনী না করে লাল ফিতা দিয়ে দায়িত্ব সারছে সিটি করপোরেশন। সেখানে ইংরেজিতে ‘ডেনজার’ লেখা দিয়ে লাল ফিতা টানানো হয়েছে। বৃষ্টির সময় এক শিশুকে দেখা গেল রশি দিয়ে ফিতা ঘেরা দিতে।

যা বলছে চসিক-সিডিএ

অরক্ষিত খাল ও নালা সংস্করের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম চট্টলার খবরকে বলেন, সাদিয়ার মৃত্যুর ঘটনার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা সিডিএকে চিঠি দিয়েছি। আগে মানুষ মারা যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এখন আমরা দেখছি মর্মান্তিক ঘটনাগুলো ঘটছে।

এর আগে বিভিন্ন দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, মানুষ চলাফেরা করতে গেলে দুর্ঘটনা হবে না? তেমন কিছু ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আগে তো মৃত্যু হয়নি।

এদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস চট্টলার খবরকে বলেন, মেয়র সাহেব গতকাল মিথ্যাচার করেছেন। জলাবদ্ধতার প্রকল্পের আগে আমরা অনেকবার চসিকের সঙ্গে বসেছি। অরক্ষিত ড্রেন-খাল সংস্কারের বিষয়টি চসিক দেখবে এমন নির্দেশনা লিখিতভাবে রয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন- মাইনর কিছু ড্রেন এবং খালের কাজ আমরা করেছি।

হত্যা মামলা করা উচিত

সেবা সংস্থাগুলোর প্রধানদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে আইনের আওতায় আনার দাবি তুলেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া। তিনি চট্টলার খবরকে বলেন, ঘটনার পর তারা পরস্পরকে দোষারোপ করছে। একটি কাজ করার পূর্বে কোনো পরিকল্পনা, ম্যানজমেন্ট ঠিক থাকে না। চেয়ারে বসে যাচ্ছেন, কিন্তু দুরদর্শিতার অভাব রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে হত্যা মামলা করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

আরকে/এমআই

এই বিভাগের আরও খবর