চকবাজার উপনির্বাচন: প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি, বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়ে ভোটাররা
রকিব কামাল: সড়কের দু’পাশে ঝুলছে ব্যানার আর ফেস্টুন। সড়ক ছাড়িয়ে মহল্লার অলিগলিতে শোভা পাচ্ছে প্রার্থীদের ছবি, মার্কা সম্বলিত প্রচারণা সামগ্রী। কিছুক্ষণ পর পর ছন্দে আর গানের তালে চলছে উচ্চ স্বরে মাইকিং। যতটুকু চোখ যায় চারপাশে ব্যানার আর ফেস্টুনে মোড়ানো।
আসন্ন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডের উপনির্বাচনকে ঘিরে প্রচারণা এখন তুঙ্গে। প্রার্থীদের বিভিন্ন আঙ্গিকের জমজমাট প্রচারণায় ভোটের হালে লেগেছে নতুন ছোঁয়া। এর সঙ্গে ভোটারদের মন জয়ে নানা ধরনের প্রতিশ্রতি দিচ্ছেন প্রার্থীরা। তবে প্রতিশ্রুতির পরেও সংশয় রয়ে যাচ্ছে ভোটারদের মনে।
সাবেক কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টুর মৃত্যুর পর এই আসন শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। নাগরিকদের ভোটে সাতবার নির্বাচিত এই কাউন্সিলরের আসনটি দখলে নিতে প্রার্থী ও সমর্থকদের পড়তে হচ্ছে কঠিন পরীক্ষায়। সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সকালে এই ওয়ার্ডের বেশ কয়েকজন ভোটার ও প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ভোটারদের মুখে ছিল নাগরিক দুর্ভোগ ও ভোগান্তির কথা। তবে তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ইশতেহারে চমকের কথা বলছেন অনেক প্রার্থী। প্রার্থীরা আবার নির্বাচনী কৌশল হিসেবে বিরত থাকছেন ইশেতেহার প্রকাশেও।
নানা কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ চকবাজার ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডে স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেশ কিছু কোচিং সেন্টার রয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক)হাসপাতাল ছাড়াও বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যাও কম নয়। শিক্ষার্থী এবং চিকিৎসা সেবা নিতে আসা মানুষের জনসমাগম লেগে থাকে এই ওয়ার্ডে। ফলে যানজটের কবলে পড়তে হয় সাধারণ মানুষ থেকে শিক্ষার্থীদের।
আর ভৌগলিক অবস্থানের কারণে পাহাড়ি ঢালু ভূমি হওয়ায় কয়েক মিনিটের বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় নাকাল হতে হয় নাগরিকদের। পাঁচ মিনিটে ডুবে যায় চকবাজারকা পসগোলা এলাকায় বাবর কলোনীতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসছেন নুর সেনেটারি দোকানের মালিক মো. আলী আব্বাস। তিনি চট্টলার খবরকে বলেন, পাঁচ মিনিট বৃষ্টি হলেই নালা আর রাস্তা একাকার হয়ে যায়। দোকানে পানি ঢুকে মালামাল নষ্ট হয়ে যায়। নিয়মিত নালা পরিষ্কার ও খনন না করায় মশার উপদ্রব রয়েছে। উঠতি বয়সী তরুণরা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ছে।
আরেক ভোটার প্রিয়া মজুমদার অভিযোগ করে বলেন, অনেক আগে থেকে এখানে জলাবদ্ধতার সমস্যাটি প্রকট। আমরা কী কখনই জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারব না? বছরের অন্য সময়ে কাউকে এটি নিয়ে কথা বলতে দেখি না। এখন ভোটের সময় এটাকে পুঁজি করে ভোট চাইছেন তারা।
তিনি আরও বলেন, নালা ও ফুটপাতের পাশের ড্রেনগুলোতে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই।কয়েকদিন আগে বৃষ্টির সময় রাস্তা পার হতে গিয়ে এক রিকশাওয়ালা ও বাচ্চা নিচে পড়ে যায়। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয়। স্থানীয় ভোটার হিসেবে এসব সমস্যা থেকে আমরা মুক্তি চাই।
কৌশল হিসেবে ইশতেহার প্রকাশে বিলম্ব
প্রিয়া মজুমদারের অভিযোগের সত্যতা মেলে ঠেলাগাড়ি মার্কায় নির্বাচন করা প্রার্থী হাজী মুহাম্মদ সেলিমের কথায়। তিনি নির্বাচনী প্রচারে জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়েছেন। চট্টলার খবরকে তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সবাইকে সচেতন হতে হবে। সিডিএ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় করপোরেশনের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। তবে দুর্ঘটনা কমাতে নালার পাশে প্রতীকী চিহ্নের ব্যবস্থা করব।
তিনি বলেন, এই ওয়ার্ডে কোনো মাতৃসেবা হাসপাতাল নেই। জয়ী হলে একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ দিয়ে কম খরচে মহিলাদের সিজারের ব্যবস্থা করব। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে যানজট কমিয়ে আনতে কাজ করব। মাদক ও ইভটিজিং দূর করতে সচেতনামূলক কার্যক্রম হাতে নিব।
ইশতেহার বিষয়ে এই প্রার্থী বলেন, ইশতেহার প্রকাশ করলে অনেকে সেটি কপি করে ফেলতে পারে। আমার ইশতেহারে চমক থাকবে। সেটি সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করব।
বিভক্তির ফায়দা লুটতে চান লাবু
স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থন দিয়ে থাকে। তবে দলটি এবার কোনো একক প্রার্থীকে সমর্থন না দেওয়ায় বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের ২০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এসব প্রার্থীর মধ্যে বেশ কয়েকজন পূর্বেও নির্বাচন করেছেন।সাবেক কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টুর স্ত্রী মেহেরুন্নিছা খানম নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। জয় নিশ্চিত করতে অলগলি চষে বেড়াচ্ছেন তিনি।
বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে হেডফোন মার্কায় লড়ছেন এ. কে. এম. সালাউদ্দীন কাউসার (লাবু)। ক্ষমতাসীন দলের বিভক্তির তিক্ততায় নির্বাচনে ফায়দা লুটতে চান তিনি।
সালাউদ্দীন চট্টলার খবরকে বলেন, যারা বিগত সময়ে মানুষকে ভোট দিতে দেয়নি তারা এখন মানুষের পা ধরে সালাম করে ভোট চাইছেন। আমরাও ভোট দিতে পারিনি। ভোটারদের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। আওয়ামী লীগের এত প্রার্থীর মাঝে আমি একা। বুঝতে পারছেন এক্ষেত্রে নির্বাচনে বিএনপি সুবিধা পাবে।
সালাউদ্দীনও জলাবদ্ধতার পাশাপাশি মাদককে প্রাধান্য দিলেও একার পক্ষে এটি দূর করা সম্ভব নয় বলে জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন চট্টলার খবরকে বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে মনোনয়ন বোর্ড থেকে স্থানীয় নির্বাচনের প্রার্থী নির্ধারণ হয়ে থাকে। আমাদের সাথে কোনো আলোচনা করে না। আলোচনা করলে আমরা সম্ভাব্য দু থেকে তিনজনের নাম পাঠাতাম। দলের বিভিন্ন বৈঠকে এসব নিয়ে কেউ কথা বলে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে এসব নিয়ে কথা বলেছি। রাজনৈতিকভাবে বিএনপি নির্বাচনে বিভক্তির সুবিধা নিবে এটাইতো স্বাভাবিক।
স্বামীর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে চান মেহেরুন্নিছা
আগামী ৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে একমাত্র মহিলা প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন মেহেরুন্নিছা খানম। তিনি স্বামীর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি চট্টলার খবরকে বলেন, আমার স্বামীর অসম্পূর্ণ কাজগুলো করে যেতে চাই। যেসব এলাকা অপরিচ্ছন্ন এবং অন্ধকার সেখানে কাজ করব। এর পাশাপাশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিব।
জয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি যেখানেই যাচ্ছি ভোটারদের সমর্থন পাচ্ছি। তারা ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছেন। তারা বলছেন আপনার স্বামী অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আমি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। জলাবদ্ধতা নিরসনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
আরকে/এমআই