chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

কবে বাজবে অনলাইন ক্লাসের বিদায় ঘণ্টা ?

ইফতেখার নিলয় : ২০২০ সালের ১৬ই মার্চ, ঘড়ির কাঁটায় দুপুর সাড়ে বারোটার কাছাকাছি…

করোনার প্রভাব থেকে দেশের শিক্ষাঙ্গনকে নিরাপদ রাখতে কিংবা করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে আগামী ১৫ দিন তথা ৩১ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়।  নিরাপত্তার কথা ভেবে শিক্ষার্থীদের এ ছুটি দেয়া হয় এবং শিক্ষার্থীরা এ ছুটিকে বেশ সানন্দেই গ্রহণ করেছিলো। নিজের, পরিবারের এবং দেশের কথা ভেবে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলো দেশের সকল স্তরের মানুষ। 

একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কয়েকশো থেকে হাজারখানেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে, করোনা যেহেতু একজন থেকে আরেকজনের কাছে দ্রুত ছড়ায় তাই সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই উদ্দেশ্যেই সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

শুরুর দিকে ১৫দিনের জন্য বন্ধ দেয়া হলেও দেশে করোনা পরিস্থিতি বেগতিক থাকায় গত এক বছরে আর খুলেনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরমাঝে শিক্ষার্থীদের একাংশ কর্তৃক বহুবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি উঠলেও সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি সরকার।

একাধারে কয়েকদফা ঘোষণায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ বন্ধের ব্যাপ্তি পার করেছে একবছর। ১৬ তারিখ বন্ধের ঘোষণা কার্যকর হয় ১৭ তারিখ থেকে।

দেশের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে আপামর জনসাধারণ সবার মাঝেই ছিলো করোনা মহামারি নিয়ে তুমুল আতঙ্ক। সবকিছু আকস্মিক থমকে যাওয়ায় সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যতে কার্যক্রম হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরাও পতিত হয় সেশন জটে ফেঁসে যাওয়ার আতঙ্কে। দিনকে দিন কেবল আতঙ্কে বেড়েই যাচ্ছিলো। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলোনা কোনোপ্রকার সমাধানের নাম কিংবা চিহ্ন।

উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় দিন কাটাতে থাকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও স্নাতকের শেষদিকে থাকা শিক্ষার্থীরা ও তাদের অভিভাবকরা।

এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগমূহুর্তেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণায় অনিশ্চয়তা তৈরি হয় এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে। দিন-কয়েক পর এবার এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত হলো। অর্থাৎ নতুন রুটিন না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে পরীক্ষার্থীদের।

এক পর্যায়ে সর্বদিক বিবেচনা বিনা পরীক্ষায় পাশ দেয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস চালু করলেও মাঝপথে তা আটকে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। কয়েকদিন না পেরোতেই সে সিদ্ধান্তকে টপকে আবারও পুনরায় অনলাইনে ক্লাস শুরু করে দেয় দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

এই ক্লাসের প্রধান লক্ষ্য ছিলো শিক্ষার্থীদের সময়ের অপচয় না করে সঠিক সময়ে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান শেষ করা, ঘরে বসে অলস সময় পার না করে তাদের সময়কে কার্যকরী করে তোলা এবং গৃহবন্দী সময়ে যাতে শিক্ষার্থীরা মানসিক অবসাদে না ভুগে।

কিন্তু এই পথ পাড়ি দেওয়া এতোটাও সহজ ছিলোনা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য। এই বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে গিয়ে সকলেই সম্মুখীন হয়েছেন নানা বাঁধা-বিপত্তির। করোনা থাবায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণায় টিউশনের মাধ্যমে যাদের আয়ের ব্যবস্থা ছিলো তারা টিউশনি হারিয়ে বিপাকে পড়েছে। তাই মোবাইলের ইন্টারনেট বিল কিংবা ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা করা নিয়েও ঝামেলা পোহাতে হয় তাদের। নতুন মাধ্যমের ক্লাসের সাথে সবাই নতুন হওয়ায় খাপ-খাইয়ে নিতে পোহাতে হয়েছে নানা দুর্ভোগ।

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাবিলা ইবনাদ চট্টলার খবরকে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের একবছর হলো, আমরা যারা ছাত্র ছাত্রী তারা একটা বড় সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাহিরে। অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম চললেও অনেকেই সেটাকে এখনো ঠিকঠাকভাবে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়নি। সময়টা আসলে পুরোপুরি ভালো যায়নি তবুও অভ্যস্ত করে নিয়েছি নিজেকে।

দেখা যায় ব্যস্ততার কারণে আমরা অনেকেই পরিবারকে সময় দিতে পারিনি। এই একবছর পরিবারের সাথে সম্পূর্ণ সময় কাটানো গেছে, অনেক অসমাপ্ত কাজও শেষ হয়েছে। সব মিলিয়ে ভালো খারাপ দুই-ই ছিলো।’

ক্লাসরুমে ফেরত না যেতে পারার আক্ষেপও কম নয় কারো কারো মাঝে। অনলাইন ক্লাসে মনযোগে ব্যাঘাত ঘটার কথাও উল্লেখ করেছেন অনেক শিক্ষার্থী। তাদের মতে মোবাইল কিংবা ল্যাপটপের স্ক্রিনে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে মনযোগ ধরে রাখাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।

অফলাইন ক্লাসের আলোচনা আর অনলাইন ক্লাসের আলোচনায় রয়েছে বিস্তর ফারাক। আবেগের অভাব রয়েছে, সঠিক যোগাযোগ সম্ভব হয়না শিক্ষকদের সাথে। অফলাইন ক্লাসে একসাথে তিন-চারজন একটা বিষয় কথা বললে শিক্ষকরা সহজেই উত্তর দিতে পারেন, কিন্তু অনলাইনে তা একেবারেই সম্ভব হয়না। তাই সঠিক জ্ঞানের আদান-প্রদান হচ্ছেনা বলে অভিযোগ তাদের।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কলেজগুলোতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও, শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই এতে অংশ নিতে পারেনি। যার মূল কারণ এন্ড্রয়েড মোবাইল, ল্যাপটপ সংকট কিংবা গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করে নেটওয়ার্ক সংকটের কারণে।

সাধারণত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নেওয়া শিক্ষার্থীরা মেধাবী হলেও এদের অধিকাংশই থাকে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা, যার ফলে প্রযুক্তির ব্যয়বহুল ব্যবহার সকলের দ্বারা সম্ভব হয়নি। ডিভাইস ও সামর্থ্য সংকটে বিপদে পড়তে হয় তাদের।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী ২০১৭-১৮ সেশনের দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিলো গত বছরের এপ্রিলে, করোনায় তা থমকে যাওয়ার পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখ থেকে পরীক্ষা শুরু হলেও তা আবারও স্থগিত হয়ে যায়। যার মূল কারণ ছিলো করোনা টিকা ছাড়া কোনোপ্রকার পরীক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন আকাশ বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের এক বছর পূর্ণ হলেও এই এক বছরে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। এর ফলে আমাদের মতো অনেক শিক্ষার্থীরা স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেমন বিমুখী হয়ে পড়েছে তেমনি শিক্ষা জীবন বিনষ্ট হচ্ছে। ঘরে বন্দী থেকে বন্ধু-বান্ধব এবং বাহিরের পরিবেশে থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় প্রচুর শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া উচ্চশিক্ষার যেমন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তেমনি সেশন জটের মতো অভিশাপে পুড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী ১৭-১৮ সেশন এখন তাদের ২য় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করতে পারেনি। যার ফলে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীরা পড়ছে চরম হতাশায়। নিরাপত্তার কথা ভেবে বন্ধ রাখা হলেও, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ প্রতিটা শিক্ষার্থীকে ঠেলে দিয়েছে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তায়।’

সঠিক সময়ে ক্লাস ও পরীক্ষা না হওয়ায় অনিশ্চয়তার মাঝে দিন কাটছে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীদের। বেশিরভাগের কাঁধেই পরিবারকে দেখভাল করার দায়িত্ব, তাই এমন কঠিন সময় পার করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফিরে দ্রুত শিক্ষাজীবনের ইতি টেনে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে মুখিয়ে আছে শিক্ষার্থীরা।

দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হওয়া পরীক্ষাগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সারাদেশে টিকা গ্রহণ কার্যক্রম চালু হওয়ায় আপাতত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা নেয়ার প্রয়োজনবোধ করছেনা কর্তৃপক্ষ। যার ফলে টিকা গ্রহণ কর্মসূচি সমাপ্ত হলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আন্দোলন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেছে শিক্ষার্থীরা। চবিতে আন্দোলন করেও চালু করা যায়নি পরীক্ষা। ঢাবি অধিভুক্ত ৭ কলেজের পরীক্ষাও পুনরায় চালু করা যায়নি আন্দোলন করে। একদিকে জীবনের ঝুঁকি অন্যদিকে ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা। এ যেন শিক্ষার্থীদের জীবনে নেমে এসেছে উভয় সংকট।

ঢাবি অধিভুক্ত ৭ কলেজের শিক্ষার্থী আফরোজা নাজনীন চট্টলার খবরকে বলেন, ‘করোনা থেকে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিত রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ দেয়া হলেও আমাদের অনেকের পরীক্ষা থমকে আছে। আমরা ভেবেছিলাম সঠিক সময়েই আমাদের শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারবো। কিন্তু এখনও তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নেয়া বাকি। দীর্ঘদিন ক্লাসরুমের বাইরে থেকে সবার মাঝেই ফলাফল বিপর্যয়ের আতঙ্ক কাজ করছে। যত দ্রুত সম্ভব যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত।’

সবকিছুকে ছাপিয়ে মন্ত্রণালয় কর্তৃক ৩০ মার্চ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে ২৩ মে থেকে। যার পূর্বে শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে হল উন্মুক্ত করা হবে ১৭ মে। তবে এরপূর্বে সবাইকেই দেয়া হবে করোনা টিকা। করোনা টিকা নিশ্চিত করে তবেই শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাতে আগ্রহী শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এর মাঝে আবার ২৩ মে পর্যন্ত অনলাইন ক্লাসে ব্যস্ত থাকা দেশের সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সকল ধরণের ল্যাব ও পরীক্ষা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। তবে এখন পর্যন্ত ইউজিসির এই অনুরোধ প্রয়োগের কোনোপ্রকার বাস্তবিক চিত্র ধরা পড়েনি।

গত কয়েকদিন করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেছে সারাদেশে। যার ফলে পুনরায় তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে কি থাকবে না! এই নিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে জন্ম নিয়েছে প্রশ্ন। দু’দিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক বলেছেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত রিভিউ হতে পারে।’

ক্লাসরুমের বাইরে একবছর অবস্থান করে শিক্ষাজীবন নিয়ে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা থেকে দ্রুত মুক্তি চায় শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাবি অধিভুক্ত ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা, তাদের মূল লক্ষ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অচলাবস্থা ভেঙে দ্রুতই যাতে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ক্লাসরুমে। আটকে থাকা ক্লাস ও পরীক্ষা দ্রুত শেষ করে কর্মজীবনের প্রবেশ করার নিশ্চয়তা চাচ্ছে সকল শিক্ষার্থী। এর পূর্বে অবশ্যই সঠিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে।

এএমএস/চখ

এই বিভাগের আরও খবর