chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

স্ক্যাবিসের প্রভাব বাড়ছে দেশে, কারণ ও প্রতিকার

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে ছোঁয়াচে রোগ ‘স্ক্যাবিস‘-এর প্রাদুর্ভাব। সরকারি হাসপাতালগুলোতে খোস-পাঁচড়া জাতীয় এ রোগে আক্রান্ত রোগীর ভিড় বাড়ছে বলেও জানা গেছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, সাধারণ মানুষ অনেক সময় ‘স্ক্যাবিস’কে খোস-পাঁচড়া বলে উল্লেখ করে। গরমের সময়ে এই ছোঁয়াচে রোগটির প্রাদুর্ভাব বেশি হলেও এখন সারা বছরই দেখা দেয়।

এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে এই চর্ম রোগ ‘স্ক্যাবিস’ কী ও কীভাবে ছড়ায়? এ রোগের লক্ষণ ও উপসর্গই বা কী? আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা কী? কীভাবে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়?

চিকিৎসকরা বলছেন, শত শত চর্ম রোগের মধ্যে এই ‘স্ক্যাবিস’ রোগই সবচেয়ে বেশি ছোঁয়াচে। একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে সংক্রমণ দ্রুত হলেও রোগটি প্রতিরোধযোগ্য। তবে সঠিক চিকিৎসা না হলে স্ক্যাবিসের কারণে কিডনি জটিলতা দেখা দিতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকরা।

ফলে এ রোগে সংক্রমণের হার ঠেকাতে ওই ব্যক্তিরই শুধু নয়, বরং ওই পরিবার বা একই ঘরে অবস্থানকারী সব সদস্যদের একসাথে চিকিৎসা করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

‘স্ক্যাবিস’ কী ও কীভাবে ছড়ায়?

‘স্ক্যাবিস’ একটি প্যারাসাইটিক বা পরজীবী চর্মরোগ। ‘সারকোপটিস স্ক্যাবিয়া’ নামে এক ধরনের পরজীবীর আক্রমণে এ রোগ হয়।

‘স্ক্যাবিস’ হয়েছে এমন কারো সরাসরি সংস্পর্শ, আক্রান্ত ব্যক্তির জামা-কাপড়, বিছানা, তোয়ালেসহ ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মাধ্যমে জীবাণু একজন থেকে আরেক জনের শরীরে ছড়ায়।

চিকিৎসক মি. মামুন বলেন, “সাধারণত গরমের সিজনে এখন বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ, স্ক্যাবিস বেশি ছড়ায়। সারা বছরই থাকে। কিন্তু এই সিজনে বেশি ছড়ায়।”

এ রোগ কীভাবে ছড়ায়, এমন প্রশ্নে মি. মামুন বলেন, “যে স্থানে ঘনবসতিপূর্ণ যেমন বস্তি এলাকা, হোস্টেল- যেখানে অনেকে একসঙ্গে থাকেন, সেখানে স্ক্যাবিস বেশি হয়। যারা নিয়মিত কাপড়-চোপড় ধোয় না, নিয়মিত গোসল করে না অর্থাৎ যারা অপরিচ্ছন্ন থাকে, তাদের মাধ্যমে এই পরজীবী বেশি আক্রমণ করে।”

স্ক্যাবিসের লক্ষণ বা উপসর্গ কী?

‘স্ক্যাবিস’ এর প্রধান উপসর্গ হলো এ রোগে আক্রান্ত হলে সারা শরীর চুলকাতে থাকে।

চিকিৎসকরা জানান, শরীরের বিভিন্ন ভাঁজে ভাঁজে যেমন দুই আঙুলের ফাঁক, কোমর, ঘাড়, নিতম্বে, যৌনাঙ্গে, হাতের তালুতে, কবজিতে, বগলের নিচে, নাভি ও কনুইয়ে এ রোগের সংক্রমণ বেশি হয়। এসব স্থানে ছোট ছোট লাল দানাদার র‍্যাশ বা ফুসকুড়ি ওঠে। যা খুব চুলকায়। এগুলো থেকে পানির মতো তরল বের হতে পারে। সাধারণত রাতে চুলকানি বেশি হয়। আক্রান্ত স্থানে চুলকানির ফলে ক্ষত হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে অন্য সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়। তবে এ রোগের উপসর্গ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক সময় ভিন্ন হতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য ধরনের উপসর্গ নিয়ে এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়।

শিশু বিশেষজ্ঞ মি. মামুন বলেন, “দেখা গেছে একটা বাচ্চা ঠাণ্ডা – কাশি, জ্বর নিয়ে আসছে সাথে স্ক্যাবিস আছে। একটা বাচ্চা নিউমোনিয়া নিয়া আসছে সাথে স্ক্যাবিস। আবার ডায়রিয়ার সাথে স্ক্যাবিসও আছে- এমন শিশু রোগী বেশি।”

কিন্তু পূর্ণবয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে লাল দানা দানা স্ক্যাবিস হলেও ‘সেকেন্ডারি ইনফেকশন’ হলে জ্বর বা অন্য উপসর্গ পাওয়া যায় বলে জানান চিকিৎসকরা।

চিকিৎসা কী?

চিকিৎসকরা বলছেন ‘স্ক্যাবিসের’ দুই ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। একটা প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা, আরেকটা প্রতিকার।

সাধারণত প্রতিরোধমূলক পরামর্শগুলোই চিকিৎসকরা বেশি দিয়ে থাকেন।

মি. মামুন বলেন, “যাতে স্ক্যাবিস না হয় বা না ছড়ায়, সেজন্য প্রতিরোধমূলক পরামর্শগুলোই আমরা দিয়ে থাকি। কারণ পরিবারের একজন সদস্যের স্ক্যাবিস রোগ হলে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে যায়। তাই সচেতন থাকতে হবে। একজনের শুধু চিকিৎসা নিলে হবে না, কারণ এটা যেহেতু ছোঁয়াচে একজনের থেকে আরেক জনের শরীরে ছড়ায়- তাই সবারই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।”

  • পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
  • গরম পানি দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে গোসল করতে হবে।
  • সাবান দিয়ে গোসল করার পর শরীর ভালো করে মুছে শুকাতে হবে।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গলা থেকে পা পর্যন্ত শরীরের সব জায়গায় লোশন বা ক্রিম লাগাতে হবে। এরপর ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর আবার সাবান দিয়ে গোসল করতে হবে। এক সপ্তাহ এভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মুখে খাওয়ার ওষুধ খেতে হবে।
  • রোগীর বিছানার চাদর, বালিশের কভার, গামছা- তোয়ালেসহ ব্যবহৃত অন্যান্য কাপড় নিয়মিত গরম পানিতে ফুটিয়ে পরজীবী-মুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে পোশাক আয়রন করে নিতে হবে। কারণ জীবাণুগুলো কাপড়ে লেগে থেকে সংক্রমণ ঘটায়।
  • ঘর-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।
  • যেসব খাবার খেলে রোগীর অ্যালার্জি হয়, সেসব এড়িয়ে চলতে হবে।
  • স্ক্যাবিস আক্রান্ত ব্যক্তিকে পুষ্টিকর খাবার ও ফলের রস খেতে হবে।
  • প্রচুর পরিমাণে পানি পান ও তরল খাবার বেশি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
  • রোগ সেরে যাওয়ার পরও রোগীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র এভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
  • শরীরে পানিশূন্যতা না হলে চর্ম রোগ কম হয় বলে চিকিৎসকরা আক্রান্তদের সুষম ও তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
  • আক্রান্ত রোগী সুস্থ হতে সাধারণত ৭দিন লাগে।
  • তবে কারো কারো ক্ষেত্রে সুস্থ হতে পনেরো্ দিন থেকে মাস-খানেক বা ইনফেকশন হলে তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে বলে জানান চিকিৎসকরা।

চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ মাসিউল আলম হোসেন বলেন, “প্যারাসাইটটা চামড়ার উপরিভাগে থাকে। এরা ভেতরে যায় না। চামড়ার উপরিভাগেই চলাচল করে, ডিম পাড়ে, বাচ্চা দেয়। নিয়মানুযায়ী প্রথম যে ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়, তাতে এগুলো মারা যাবে।”

“তারপরে আবার ৫ বা ৭ দিন পরে রিপিট করাই। সেক্ষেত্রে প্যারাসাইটের ডেড যে উপাদানগুলো থাকে সেটা আবার চুলকানি বাড়ায়। তখন এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আবার মেডিসিন দিতে হয়।”

তবে চুলকানি হলেই তা ‘স্ক্যাবিস’ রোগ নয় বলে জানান চিকিৎসকরা। তাই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য চর্ম রোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

কিভাবে প্রতিরোধ করা যায় ?

  • ছোঁয়াচে এ রোগটির সংক্রমণ এড়াতে বা প্রতিরোধে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
  • সুস্থ ব্যক্তিদের আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির পোশাক, বিছানা ও সাবান ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
  • পরিবারের বা ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে একজন আক্রান্ত হলে অন্যদেরও স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
  • তাই একজন আক্রান্ত হলে তার সঙ্গে থাকা অন্য সবার চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ মি. হোসেন বলেন, “এই প্যারাসাইটটা (সারকোপটিস স্ক্যাবিয়া) যখন শরীরে ঢোকে, ঢোকার পরে সিম্পটম্প পাওয়া যায় দুই থেকে তিন সপ্তাহ পরে। অলরেডি আপনি ইনফেক্টেড কিন্তু টেরই পাবেন না। সমস্যাটা এ জায়গায়। আর এ কারণেই একজন আক্রান্ত হলে ওই স্থানের সবার চিকিৎসা শুরুর পরামর্শ দেই।”

মি. হোসেন জানান, এ রোগে প্রথম থেকেই সচেতন না হলে সেকেন্ডারি ইনফেকশনের কারণে অনেক সময় কিডনি জটিলতাও দেখা দিতে পারে।

” এ রোগে সচেতন না হলে সেকেন্ডারি ইনফেকশন হয়। এটা হওয়ার পর কেউ যদি ট্রিটমেন্ট না নেয়, নেগলেক্ট করে, তবে আলটিমেটলি এটা কিন্তু কিডনিকে ইনভলভ করে। কিডনি ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে ” বলেন তিনি।

“বিপদটা এখানে। তবে একটু লং টার্মের ব্যাপার। এটার খারাপ সাইডটা হলো এটা। এজন্য আমার কাছে যখন রোগী আসে আমি কিডনিটা চেক করে নেই,” বলেন এই চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ।

তাসু/চখ