chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

নদী পরিচিতি : কর্ণফুলী

কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী, যা শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক জলধারা নয়, বরং এই অঞ্চলের অর্থনীতি, পরিবেশ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপত্তি হওয়া এই নদীটি প্রায় ১৬১ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। কর্ণফুলী মিজোরামের সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের জল নিষ্কাশন ব্যবস্থারও প্রধান বাহক।

১৯৬০ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর কাপ্তাই উপজেলায় কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এটি বাংলাদেশের একমাত্র পানি-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, যা কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নামে খ্যাত। এই প্রকল্পটি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (BPDB) পরিচালনা করে থাকে এবং এটি দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তবে এই বাঁধ নির্মাণের ফলে রাঙামাটি ও এর আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে যায় এবং প্রায় ১৮ হাজার পরিবার তাদের বসতভিটা হারায়। এই কারণে পার্বত্য অঞ্চলে একটি বড় ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে।

কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দর—চট্টগ্রাম বন্দর। এই বন্দর দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত হয় এবং জাতীয় অর্থনীতিতে এর অবদান অপরিসীম। কর্ণফুলী নদীর পানিপথ ব্যবহার করে বিভিন্ন এলাকা থেকে পণ্য সহজে বন্দরে পৌঁছে দেওয়া যায়, যা বাণিজ্যিক দিক থেকে অত্যন্ত লাভজনক।

নদীটি শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বাণিজ্যের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়; এটি কৃষি, মৎস্য এবং নৌপরিবহনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পার্বত্য অঞ্চলের কৃষকরা নদীর পানি সেচকাজে ব্যবহার করে থাকে এবং নদীঘেঁষা এলাকাগুলোতে নানা ধরনের শস্য উৎপাদিত হয়। কর্ণফুলী নদীতে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায়, যা স্থানীয় মানুষের জীবিকা নির্বাহের একটি উৎস।

তবে কর্ণফুলী নদী আজ নানা সমস্যার সম্মুখীন। নগরায়ন, শিল্পকারখানার বর্জ্য ফেলা, অবৈধ দখল ও অপরিকল্পিত ড্রেজিং এর ফলে নদীটির স্বাভাবিক গতিপথ ও পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে। নদীর পাড় দখল করে নির্মিত অবৈধ স্থাপনাগুলো নদীর প্রশস্ততা কমিয়ে দিয়েছে এবং জলপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশগত সংকট তৈরি করতে পারে।

এই নদীর গুরুত্ব শুধু অর্থনৈতিক বা ভৌগোলিক নয়, বরং এটি চট্টগ্রামের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অংশ। কর্ণফুলী নদীকে ঘিরে অনেক গল্প, কাব্য, গান এবং জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা গড়ে উঠেছে, যা এই অঞ্চলের মানুষের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশের একটি অমূল্য সম্পদ। এর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, এবং পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই নদীকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব। সরকারের পাশাপাশি আমাদের সকলেরই দায়িত্ব এই নদীকে রক্ষা করা, যেন এটি আগামীতেও দেশের উন্নয়নের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর