chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

দেড় হাজার বছরেরও ঠাঁই দাঁড়িয়ে পটিয়ার ফারাতারা বৌদ্ধমঠ

প্রথমেই বলে রাখছি গৌতম বুদ্ধ ( জন্ম আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৬ অথবা ৪৮৬অব্দ) ( মৃত্যু মহাপরিনির্বাণ লাভ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অথবা ৪০০ অব্দে, (৮০ বছর বয়সে মারা যান ) এর জীবনের অংশে বিশ্রামাংশে একটি ফরাতরা স্মৃতি স্মারক এটি। গৌতম বুদ্ধের বয়সের সাথে যুক্ত ইতিহাসে ফরাতরা মন্দিরের বয়স সমানে সমান। সে মতে ফরাতরা মন্দির টি অতীব প্রাচীন ও ইতিহাসে গৌরবময় অংশ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক জনপদ পটিয়া, যার গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন চক্রশালা ফরাতারা মন্দির।

পটিয়া সদর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত এই তীর্থস্থানটি একসময়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে বিবেচিত ছিল। বর্তমানে যদিও এই প্রাচীন মন্দিরটির চারপাশে কোনো বৌদ্ধ পরিবার বসবাস করে না, তথাপি এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও ধর্মীয় গুরুত্ব চক্রশালাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধতীর্থে পরিণত করেছে।

ফরাতরা মন্দিরের সূচনা ও ধ্বংসাবশেষ

চক্রশালা ফরাতরা মন্দিরের প্রাচীরে খোদাই করা শিলালিপিতে লেখা আছে, “ফরাতারা স্তুপ নবতর পর্যায়ে সংস্কার ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ, চক্রশালা বৌদ্ধতীর্থ সংরক্ষণ কমিটি, হাইদগাঁও, পটিয়া, চট্টগ্রাম।” এটি থেকেই ধারণা করা যায়, ঐ সময়ের আগেই মন্দিরটি অস্তিত্বে ছিল এবং সেটিকে পুনরায় সংস্কার করে বর্তমান রূপ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মন্দিরে প্রবেশদ্বার হিসেবে একটি সুদৃশ্য তোরণ, সীমানা প্রাচীর, পূর্বদিকে একটি পাকা ঘাট ও টিউবওয়েল যুক্ত পুকুর রয়েছে। যদিও আশপাশে বৌদ্ধ বসতির কোনো অস্তিত্ব নেই, তবুও জনশ্রুতি ও প্রাচীন দলিলপত্র অনুযায়ী, এখানে একসময় বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল, যারা কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে।

নামের উৎপত্তি চক্রশালা ও ফরাতরা

চক্রশালা নামের উৎপত্তি নিয়েও রয়েছে নানা মত। কেউ বলেন, সুদূর রেঙ্গুন (বর্তমান বার্মা / মিয়ানমার) থেকে আসার পথে তথাগত গৌতম বুদ্ধ এখানে অবকাশ যাপন করেছিলেন এবং “চংক্রমণ” বা বিচরণ করেছিলেন বলেই এই স্থানকে “চক্রশালা” বলা হয়। অন্যদিকে “ফরাতরা” শব্দটি বার্মিজ উৎসের, যেখানে “ফরা” অর্থ বুদ্ধ এবং “তরা” অর্থ বিশ্রামের স্থান। তাই “ফরাতরা” অর্থ দাঁড়ায় “বুদ্ধের বিশ্রামের স্থান”।

চক্রাসন ও দীপঙ্কর স্থবিরের যোগসূত্র

জনশ্রুতি অনুযায়ী, চক্রশালা মন্দিরে একসময় একটি বুদ্ধচক্র পাথর ছিল, যাতে বুদ্ধের ৩২টি লক্ষণ ও ৮০টি অনুরঞ্জন অঙ্কিত ছিল। এই মন্দিরটি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য শীলভদ্র মহাস্থবিরের শিষ্য দীপঙ্কর স্থবির কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলেই ধারণা করা হয়। তিব্বতের তাঞ্জুর গ্রন্থেও চক্রশালার উল্লেখ আছে বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, রত্নাকর নামক গ্রন্থ, যা ভদন্ত ধর্মতিলক ও বীরেন্দ্র মুৎসুদ্দী অনুবাদ করেছিলেন, তাতে চক্রশালার অতীত নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এই গ্রন্থে চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের আদি ইতিহাসেরও ধারাবিবরণী পাওয়া যায়।

আদিপুরুষ ছান্ধমার ইতিহাস

চট্টলার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আদি পুরুষ হিসেবে যিনি পরিচিত, তাঁর নাম ছান্ধমা। তিনি মগধ দেশ হতে আকিয়াবের ছান্ধমা পাহাড়ে উপনিবেশ স্থাপন করেন এবং পাহাড়ের শীর্ষে একটি ধাতুচৈত্য নির্মাণ করেন। তাঁর দুই পুত্র—গৃহী চেন্দি ও ভিক্ষু রাজমঙ্গল—এর মধ্যে চেন্দির বংশধররাই পরবর্তী সময়ে চক্রশালার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। চেন্দির পুত্র কেয়ক্চু ব্রহ্মদেশে গমন করে চন্দ্রজ্যোতিঃ নামে ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করেন। বিশ বছর ধরে শিক্ষা অর্জনের পর দেশে ফেরার সময় তিনি একটি চক্রাসন, তিনটি বুদ্ধমূর্তি ও বুদ্ধের অস্থিধাতু আনেন। এই মূর্তিগুলো পরবর্তীতে বিভিন্ন বিহারে স্থাপিত হয়।

চক্রশালার প্রতিষ্ঠা ও মেলার সূচনা

চন্দ্রজ্যোতিঃ স্থবির যখন পটিয়ার হাইডমজা নামক এক ধনী ব্যক্তির আম্রকাননে উপস্থিত হন, তখন তাঁর পাণ্ডিত্য ও ধর্মজ্ঞান দেখে হাইডমজা মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। হাইডমজা জানতে পারেন, স্থবির চক্রিয়ার চেন্দির পুত্র। পরে পিতা-পুত্রের পুনর্মিলনের মাধ্যমে চক্রাসনের একটি অংশ চন্দ্রজ্যোতিঃ হাইডমজাকে উপহার দেন। হাইডমজা এই চক্রাসন স্থাপন করেন নিজ গ্রামে এবং যে মন্দির নির্মিত হয় তা-ই চক্রশালা মন্দির নামে পরিচিত হয়।
বিষুব সংক্রান্তিতে এই স্থানে প্রথম মেলার আয়োজন করেন চন্দ্রজ্যোতিঃ, যা আজও প্রতি বছর চৈত্রের শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এটি একটি বৃহৎ ধর্মীয় ও সামাজিক সমাবেশে পরিণত হয়েছে, যেখানে হাজার হাজার বৌদ্ধ ধর্মপ্রাণ মানুষ একত্রিত হন।

আধুনিককালের পুনঃনির্মাণ ও সংরক্ষণ

সময়ের আবর্তে মন্দিরটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে পড়েছিল। সংঘরাজ পূর্ণাচার ধর্মাধার চন্দ্রমোহন মহাস্থবির ও প্রত্নতত্ত্ববিশারদ জগতচন্দ্র মহাস্থবিরের উদ্যোগে মন্দিরটি পুনরায় নির্মিত হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় বিশিষ্টজনদের প্রচেষ্টায় এই মন্দির ও এর পরিকাঠামো সংস্কার করা হয়েছে। বিশেষ করে নবীন চন্দ্র বড়ুয়ার উদ্যোগে সাধারণ জনগণের অর্থানুকূল্যে পুনঃসংস্কার।

চক্রশালা ফরাতরা মন্দির কেবল একটি ধর্মীয় তীর্থস্থান নয়, বরং এটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বৌদ্ধ ঐতিহ্যের এক অনন্য সাক্ষ্য। যদিও আজ এখানে বৌদ্ধ বসতি নেই, তবে শত শত বছর ধরে চলে আসা চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, মন্দিরের পুনঃসংস্কার এবং ইতিহাসচর্চায় এ স্থানকে নতুনভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। এই মন্দির কেবল অতীতের স্মারক নয়, বরং তা ভবিষ্যতের জন্য এক মূল্যবান সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। স্থানীয় প্রশাসন ও ইতিহাসানুরাগীদের আরও মনোযোগ দিয়ে চক্রশালাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও পর্যটন স্থানে পরিণত করার উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

◑ ফখ|চখ

এই বিভাগের আরও খবর