chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

দখল দূষণে বিপর্যস্ত কর্ণফুলী নদী

চট্টগ্রামের বুক চিরে বয়ে চলা কর্ণফুলী নদী, যার শেষ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা এই নদী বর্তমানে দখল, দূষণ ও অব্যবস্থাপনায় অনেকটাই এখন অস্তিত্ব সংকটে।

কর্ণফুলীর তীর ঘেষে শতাধিক অবৈধ স্থাপনার পাশাপাশি ১৭টি শিল্প জোনে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় প্রায় ৮০০ টির মতো শিল্পকারখানা। এসব কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ও নগরীর ময়লা-আবর্জনায় একদিকে যেমন দূষিত হচ্ছে নদীর পানি অন্যদিকে ভরাট হচ্ছে নদীর তলদেশ।

ছোট-বড় প্রায় ১৯টি খালের মাধ্যমে গৃহস্থালি, শিল্প-কারখানা, ডায়িং মিলের তরল ও কঠিন বর্জ্য সরাসরি পড়ছে কর্ণফুলীতে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নদীর বুকে যত্রতত্র ভাসছে পলিথিনবর্জ্য। তীরেও একই চিত্র, মানুষের ব্যবহার করা পলিথিনের স্তূপ। 

      পরিবেশবাদী সংগঠন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের করা ২০২২ সালের জরীপ অনুযায়ী :

  • চাকতাই খালের মোহনার উত্তর পাশে নদীতে গভীরতা পাওয়া যায় মাত্র সাড়ে ১৩ ফুট।
  • ‌দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি গভীরতা পাওয়া যায় ৪৮ ফুট।
  • ‌রাজাখালী খালের মোহনায় গভীরতা পাওয়া যায় ৪ ফুট।
  • ‌ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় নদীর গভীরতা পাওয়া যায় সাড়ে সাত ফুট।

নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অলিউর রহমান দৈনিক চট্টলার খবরকে বলেন,’আমরা কর্ণফুলী নদী রক্ষায় ২০০৭ সাল থেকে আন্দোলন শুরু করি, এরপর ২০১০ সালের দিকে হাইকোর্টে একটা মামলা করি। সেই মামলায় হাইকোর্টের নির্দেশে কর্ণফুলীর তীরে সরেজমিন জরিপ করে ২ হাজার ৮১টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে হাইকোর্টকে জানায়। হাইকোর্ট সেই তথ্যের ভিত্তিতে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিলের ডিবিশন থেকে সেই রায়টা আসার পরও এখনও সেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয় নি।’

‘এছাড়া বন্দর মোহনা থেকে হালদা মোহনা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা বন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে। মূলত বন্দর পরিচালনার জন্য এই নদীটার দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে। এই নদী রক্ষা করার দায়িত্বও তাদের।  অথচ, বন্দর এই কর্ণফুলী নদীকে ব্যবহার করে লক্ষ-কোটি টাকা আয় করে। কিন্তু তারা এই নদী রক্ষার জন্য যেসব ব্যবস্থাপনা করা প্রয়োজন তা করছে না। প্রথমত যেসমস্ত অবৈধ স্থাপনা রয়েছে তার মধ্যে বন্দরের দখল অনেক বেশি আছে। এবং সম্প্রতি বন্দর কর্ণফুলী নদীর তীরে প্রায় ৩শত মিটার দখল করে, সেটি ভরাট করে খননের নামে সেখানে মাছ বাজার দিয়েছে।  যতটুকু বাকি ছিলো, সেগুলো অন্য পক্ষকে ইজারা দেওয়ার জন্য টেন্ডার দিয়েছে। এসব কারণে আমরা বন্দরের বিরুদ্ধে ‘কনটেম কোর্ট’ করেছি। আদালতের আদেশ অমান্য করার যে বিষয় সেটা এনেছি। আদালত আগামী ৫ সপ্তাহের মধ্যে অথবা ৬ সপ্তাহের মধ্যে এই আদেশটি নিষ্পত্তি করবেন এবং বন্দর চেয়ারম্যানকে বাধ্য করবেন তারা নদী ভরাট এবং দখল করে যেসমস্ত অনিয়ম করছে সেটা প্রতিহত করার জন্য।’

কর্ণফুলীর এমন নাজেহাল দশা থেকে মুক্ত করতে হলে কী করা উচিত, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ আমাদের দাবি হলো, কর্ণফুলী নদীর আরএস সিট অনুযায়ী যেখানে যেমন ছিলো ঠিক সেরকম সীমানা নির্ধারণ করে উভয় তীর সংরক্ষণ করে যেভাবে তার স্বাস্থ্য ঠিক রাখা যায় সেভাবে কাজ করতে হবে। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট একটা যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন, অর্থাৎ প্রত্যেকটি নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছে। একটা নদীর গতি প্রবাহ আছে সেটি ঠিক রাখতে হলে নদীকে সুস্থ রাখতে হবে।  এই কাজটি জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের। তারা সেই কাজটা সঠিকভাবে করছে না বলে আমাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দাবি হলো, ২ হাজার ৮১ টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হোক। চট্টগ্রাম নগরীর যেসমস্ত ৩৬ টি খাল দিয়ে সরাসরি বর্জ্য কর্ণফুলীতে পড়ছে সেগুলো বন্ধ করা হোক। প্রবাহমান খালগুলোর গতিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে বর্জ্য যাতে না যায় সেটা নিশ্চিত করা হোক।  এতে করে কর্ণফুলী নদী রক্ষা হবে এবং এটার যে জীববৈচিত্র্য সেটা টিকে থাকবে। ‘

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, কর্ণফুলী নদীতে সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৩৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হচ্ছে। এসব বর্জ্য নদীর তলদেশের মাটি, পানি, মাছ ও উদ্ভিদের ক্ষতি ছাড়াও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে বলে গবেষণায় বলা হয়।

রমিজ মিয়া নামে এক মাঝি জানান, ‘ আমি গত ২০ বছর যাবৎ এখানে মাছ ধরি, তখন পানিতে এত ময়লা দেখা যেত না, মাছও ভালো পাওয়া যেত। কিন্তু এখন জাল নিয়ে ৫/৬ ঘন্টা সময় পাড় করলেও তেমন মাছ পাওয়া যায় না।’

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সমীক্ষা বলছে, কর্ণফুলী নদীতে এক সময়ে বেলে, কাঁচকি, চান্দা, পুঁটি, বাচা, চেলা, পাওয়া যেত। আইড়, কালিবাউস, কাতল, রুই, মৃগেল, বোয়াল, ফলই, পাঙ্গাস, নাইলোটিকা, গলদা, চিংড়ি, ছোট হরিণা চিংড়ি মাঝে মাঝে পাওয়া যায়। ২০ বছর আগে বাবমি, চিতল, কাঁচকুড়ি, পারশে ও বাঁশপাতা মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন আর পাওয়া যায় না। নির্বিচারে মৎস্য আহরণ, কারেন্ট জাল, ছোট ফাঁস জালের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এবং দূষণের কারণে মাছ এবং জলজ উদ্ভিদ কমে যাচ্ছে। নদীতে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের স্বীকৃত স্থান বা মৎস্য অভয়াশ্রম না থাকায় অনেক মাছ প্রজননের অভাবে হারিয়ে গেছে বলে সমীক্ষায় বলা হয়েছে।

নদী রক্ষা কমিশন বলছে, কর্ণফুলীতে ৩৩ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেছে। এছাড়াও নদীতে শামুক, কাঁকড়া ও ঝিনুক পাওয়া যায়। চিল, সাদা বক, মাছরাঙা, ভুবন চিল, গাঙ্গচিল, পানকৌড়ি দেখা যায়। মাছসহ জলজপ্রাণী দিন দিন কমে যাচ্ছে। সরপুটি, ঘাউরা, রিঠা, বাঘাআইড়, বাঁশপাতা, ফ্যাসা, অলুয়া, চাকা মাছ ও রোশনাই চিংড়ি-কাঠালি চিংড়ি বর্তমানে বিরল। কিন্তু দুই দশক আগেও এসব মাছ সচরাচর পাওয়া যেত। এতে মৎস্যজীবী ও জেলে সম্প্রদায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এদিকে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত হয়। এরমধ্যে ৮১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্তির পথে, ৬১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। দূষণ ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বাকি উদ্ভিদসমূহ বিপন্ন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।

চখ/ককন

এই বিভাগের আরও খবর