chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

বরমার জৈন্য রাজার রাজবাড়ী: ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষী

প্রাচীন বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অনেকগুলো আজও অযত্ন-অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার বরমা ইউনিয়নের সেবন্ধী গ্রামে অবস্থিত জৈন্য রাজার রাজবাড়ী তারই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে নির্মিত এই রাজবাড়ী আজ ধ্বংসপ্রায়, তবে এখনো ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে টিকে আছে। স্থানীয় জনগণের ভাষ্যমতে, এটি মগ শাসন আমলের একটি স্থাপনা, যা তখনকার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বহন করে।

জৈন্য রাজবাড়ীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:- প্রাচীন চট্টগ্রামে মগ শাসকদের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। মগদের শাসনামল মূলত আরাকান রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা বর্তমানে মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্ত। স্থানীয় প্রবীণদের মতে, এই রাজবাড়ী মগ শাসকদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, যা প্রাচীনকালে প্রশাসনিক ও কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

রাজবাড়ীটি শঙ্খ নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত, যা প্রাচীনকালে জলপথে যোগাযোগের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক ছিল। এর মাধ্যমে সহজেই বান্দরবান, মিজোরাম, ভারত ও বার্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হতো। এই রাজবাড়ী সম্পর্কে প্রচলিত একটি কাহিনি হলো, এখানে এক সময় জৈন্য রাজা নামে এক শাসক বাস করতেন। যদিও এই নামের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ এখনো মেলেনি, তবে স্থানীয় জনগণ একে ‘জৈন্য রাজবাড়ী’ বলে জানে। মগদের ধর্মগুরুদের স্থানীয় ভাষায় ‘রাউলি’ বা ‘ললি’ নামে ডাকা হতো, আর এই রাজবাড়ীর কাছেই ‘রাউলি বাগ’ নামের একটি স্থান রয়েছে। এর মাধ্যমে ধারণা করা যায়, এটি একসময় মগদের ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল ছিল।

স্থাপত্য ও বর্তমান অবস্থা

রাজবাড়ীটি বর্তমানে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। এটি একসময় এক বিশাল স্থাপনা ছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রবীণদের মতে, এর চারপাশে শক্ত দেয়াল ছিল এবং অভ্যন্তরে রাজপ্রাসাদ, প্রহরীদের বাসস্থান ও প্রশাসনিক দপ্তর ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি ধ্বংস হতে থাকে এবং এখন এর জায়গাটি প্রায় মুসলিম কবরস্থানে পরিণত হয়েছে।
বাড়ীটির স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণ কৌশল নিয়ে এখনো তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। তবে ধারণা করা হয়, এতে আরাকান শৈলীর প্রভাব ছিল। এটি যদি যথাযথ সংরক্ষণ করা হয়, তবে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।

কিরাত রাজ্যের সম্ভাব্য সম্পর্ক

বিভিন্ন ইতিহাসবিদগণ ধারণা করেন, এই অঞ্চলে একসময় কিরাত সম্প্রদায়ের শাসন ছিল। কিরাতরা মূলত তিব্বতীয়-বর্মি জাতিগোষ্ঠীর অংশ, যারা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিল। জৈন্য রাজবাড়ীর সঙ্গে কিরাত রাজ্যের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা গবেষণার বিষয়। তবে ইতিহাস ও স্থাপত্য বিশ্লেষণ করলে ধারণা করা যায়, এটি কিরাত ও মগ শাসনের মধ্যবর্তী কোনো এক সময় নির্মিত হয়েছিল।

সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

জৈন্য রাজবাড়ী বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি শুধু একটি প্রাচীন রাজবাড়ী নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার শাসনব্যবস্থা, বাণিজ্যপথ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের এক নীরব সাক্ষী। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি দিন দিন বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন কিংবা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কোনো নজরদারি নেই, ফলে এটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিদেশি গবেষক বা সংস্থাগুলো যদি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়, তবে এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হতে পারে। সরকার যদি এই স্থাপনাটির সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়, তবে এটি হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। পর্যটন শিল্পের বিকাশেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। চট্টগ্রামের অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মতো এটিও সংরক্ষণ করে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে।

জৈন্য রাজবাড়ী বাংলাদেশের ইতিহাসের এক মূল্যবান অংশ, যা আজ ধ্বংসের পথে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ও যথাযথ সংরক্ষণের মাধ্যমে এটি বাংলাদেশের সমৃদ্ধ অতীতের গৌরব তুলে ধরতে পারে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এই নিদর্শন সংরক্ষণ করা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ থেকে তাদের ইতিহাস জানতে পারে। অতীতের স্মৃতিচিহ্ন হারিয়ে যাওয়া মানে ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হারিয়ে যাওয়া। তাই এখনই সময় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার। ২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে রাজ বাড়ীর অংশ বিশেষ পরিদর্শন করে এই প্রবন্ধটি লিখেছি।

তথ্যসহায়তা : চন্দনাইশের সমাজ সংস্কৃতির ইতিহাস – সোহেল ফখরুদ-দীন।
ফখ|চখ

এই বিভাগের আরও খবর