chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপবাসীর স্বপ্নপূরণ

অবশেষে বাস্তবে রূপ নিলো সন্দ্বীপবাসীর বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্ন। ট্রলার ও স্পিডবোটের ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রার অবসান ঘটিয়ে সমুদ্র পথে চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ ফেরি সার্ভিস চালু হয়েছে। এতে দ্বীপবাসীর জীবনযাত্রায় নতুন দিগন্তের সূচনা হলো। যুগ যুগ ধরে যাত্রাপথের সীমাহীন ভোগান্তি, প্রাণহানি, আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির বেড়াজাল পেরিয়ে প্রাপ্তির সূচনায় উচ্ছ্বাসের ঢেউ লেগেছে সন্দ্বীপবাসীর মধ্যে। প্রাণের জনপদ নিয়ে তারা এখন বুনছেন নতুন নতুন স্বপ্ন।

সোমবার (২৪ মার্চ) সকালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ফেরিঘাট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ফেরি ছেড়ে যায় সন্দ্বীপের গুপ্তছড়ার উদ্দেশে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চালু হওয়া এ সেবার উদ্বোধন করেন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

দীর্ঘদিন ধরে সন্দ্বীপের মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজের জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হতো। বৈরী আবহাওয়ায় দ্বীপটি প্রায়ই মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত, যার ফলে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার জন্য নেওয়াটা হয়ে উঠত দুঃসাধ্য। এখন ফেরি সার্ভিস চালুর মাধ্যমে সেই কষ্টের দিন শেষ হলো।

বঙ্গোপসাগর পাড়ের দ্বীপ উপজেলা চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের আরেক তীরে চট্টগ্রামের স্থলভাগ সীতাকুণ্ড উপকূল থেকে নৌপথে সন্দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ১০ মাইল। মাঝে বঙ্গোপসাগরের চ্যানেল। নৌপথ পাড়ি দিয়ে সন্দ্বীপ পৌঁছানো রীতিমতো যুদ্ধের মতো ছিল বিচ্ছিন্ন এ জনপদের মানুষের। মৌসুমের স্বাভাবিক সময়ে ছোট-বড় নৌযানে কোনোমতে সন্দ্বীপ পৌঁছানো গেলেও তীরে নেমে দীর্ঘ কাদায় ঢাকা পথ পাড়ি দিয়ে মূল সড়কে উঠতে হতো যাত্রীদের। আর বর্ষাকালে সাগর উত্তাল থাকলে সন্দ্বীপ পৌঁছানো রীতিমতো দুঃসাধ্য ছিল।

নিয়মিত ঘটেছে অংসখ্য প্রাণহানি। ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপ উপকূলে পৌঁছানোর পর সি-ট্রাক থেকে যাত্রী নামানোর সময় ‘লালবোট’ (উপকূলে যাত্রী নামানোর ছোট নৌকা) ডুবে ১৮ জন প্রাণ হারান। এ ঘটনা ‘সন্দ্বীপ ট্র্যাজেডি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল স্পিডবোট ডুবে একই পরিবারের তিন শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়। বছরের ১৯ আগস্ট কাঠের তৈরি ট্রলার থেকে নামতে গিয়ে সাগরে পড়ে এক ব্যক্তি মারা যান।

এ অবস্থায় নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রামে আন্দোলন গড়ে তোলে ‘আমরা সন্দ্বীপবাসী’সহ বিভিন্ন সংগঠন। সভা-সমাবেশ, গোলটেবিল-সেমিনার, জনপ্রতিনিধিদের কাছে স্মারকলিপি দেওয়াসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলেন সংগঠকরা। দলমত নির্বিশেষে সন্দ্বীপের মানুষ এক কাতারে আসেন দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে।

জানা গেছে, ২০১২ সালে সীতাকুণ্ড ও সন্দ্বীপে দু’প্রান্তে জেটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ১০ বছর ধরে জেটিগুলো অব্যবহৃত থাকার পর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ফেরি সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। কিন্তু অবকাঠামো জটিলতায় সেই সিদ্ধান্ত আটকে ছিল।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান সন্দ্বীপের সন্তান মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। উপদেষ্টা ফাওজুলের তদারকিতে অবকাঠামো নির্মাণ ও ফেরি সার্ভিস চালুর কার্যক্রমে গতি আসে।

গত ১৯ মার্চ দুপুরে নির্ধারিত ফেরি ‘কপোতাক্ষ’ পরীক্ষামূলকভাবে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া প্রান্ত থেকে যাত্রা করে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ফেরিঘাটে। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো সন্দ্বীপের যাতায়াত ব্যবস্থায় নতুন ইতিহাসের সূচনা হয়। ফেরি আসার খবরে সেদিন সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া প্রান্তে শত, শত মানুষ প্রবল আগ্রহ নিয়ে ভিড় জমায়। এরপর ২৪ মার্চ থেকে ওই রুটে নিয়মিত ফেরি চলাচল শুরুর ঘোষণা দেয় বিআইডব্লিউটিএ।

বিআইডব্লিউটিএ চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মো. কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, পরীক্ষামূলকভাবে ফেরি নিয়ে সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপে পৌঁছাতে তাদের সোয়া এক ঘণ্টার মতো সময় লেগেছিল। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাগর উত্তাল না থাকলে ফেরি চলাচলে এর বেশি সময় লাগবে না। আপাতত কপোতাক্ষ ফেরিটি দিনে একবার সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপ যাবে এবং সেখান থেকে আবার ফিরে আসবে।

`প্রতিটি ফেরিতে একসঙ্গে ৩৫টি যানবাহন এবং ৬০০ যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। প্রতিদিন চারবার জোয়ার-ভাটার সময় অনুযায়ী চলাচল করবে ফেরি। চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপ যেতে সময় লাগবে মাত্র এক ঘণ্টা ১০ মিনিট।`

এই সার্ভিস চালুর পাশাপাশি ঢাকা-সন্দ্বীপ রুটে বিআরটিসির বাস সার্ভিসও চালু করা হয়েছে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট-সি বিচ-নিমতলা-বাঁশবাড়িয়া ফেরিঘাট-সন্দ্বীপ এনাম নাহার মোড় রুটে এসি বাস পরিষেবা শুরু হয়েছে। ফেরি দিয়ে বাস, ট্রাক, ট্যাংক লরি, মিনিবাস, প্রাইভেটকারসহ সবধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে। ফেরির মোট ধারণক্ষমতা ২৪টি পণ্যবোঝাই ট্রাকের সমান। ফলে সন্দ্বীপের মানুষ সহজেই রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারবে। তবে এই রুটে চলাচলের জন্য আরও একটি ফেরি নির্মাণাধীন আছে বলে তিনি জানান।

সামনে যে চ্যালেঞ্জ :

দেশে প্রথমবারের মতো উপকূলীয় নদীবন্দর এলাকায় ফেরি সার্ভিস শুরু করেছে সরকার। পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকায় বেশ কিছু সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। ইতিমধ্যে সমস্যায় পড়ে উদ্বোধন ৫ মার্চের পরিবর্তে পিছিয়ে তা ২৪ মার্চে নির্ধারণ করতে হয়েছে।

ফেরি সার্ভিসের স্থায়িত্ব টিকিয়ে রাখতে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে, জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেন, মার্চ মাসের

পর থেকেই ধীরে ধীরে সন্দ্বীপ চ্যানেল অশান্ত হয়ে ওঠে। এখানে জোয়ার-ভাটায় পানির স্তরের হ্রাস-বৃদ্ধির পার্থক্যও অত্যধিক। বর্তমানে ভরা কটাল ও মরা কটালে পানিস্তরের হ্রাস–বৃদ্ধি প্রায় ২১ ফুট পর্যন্ত হয়, যা দেশের অন্য কোথাও হয় না। জোয়ার-ভাটায় এ রকম বিশাল তারতম্যের কারণে এ চ্যানেলে ফেরি চালানো অনেক কঠিন হবে। এ পথ আমাদের দেশে উপকূলীয় চ্যানেলে প্রথম। ফলে কিছু সমস্যার মুখোমুখি তো হতে হবে। যেহেতু বর্তমান ফেরি এ অঞ্চলে চলাচলের উপযোগী নয়, তাই এপ্রিল মাস থেকে ফেরি চলাচল হয়তো বন্ধ রাখতে হবে। কিন্তু বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ উপকূলীয় এলাকায় চলাচল উপযোগী ফেরি নির্মাণ করছে। আগামী বছর থেকে এই সমস্যা আর থাকবে না বলে আশা করা যায়। কিন্তু এ চ্যানেলে পলি জমার হার অনেক বেশি। ফলে বারবার ড্রেজিং করা লাগতে পারে।

ফেরি কপোতাক্ষের মাস্টার মো. শামসুল আলম বলেন, ফেরিতে মসৃণভাবে গাড়ি ওঠাতে হলে পন্টুন এক জায়গায় স্থির থাকতে হবে। জোয়ার-ভাটায় শুধু ওঠানামা করবে। কিন্তু এখানে ভৌগোলিক বা অন্য কোনো কারণে পন্টুন পাশাপাশি সরে যায়। এটা এক সমস্যা। এ ছাড়া এ নৌপথে জেলেদের অনেক জাল রয়েছে। এ জাল রাখা যাবে না।

ফেরির সময়সূচি :

উদ্বোধনের দিন থেকে পরবর্তী আট দিনের একটি সময়সূচি প্রকাশ করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেন, আপাতত ৩১ মার্চ পর্যন্ত ফেরির সময়সূচি দেওয়া হয়েছে। এরপর আবহাওয়া ভালো থাকা সাপেক্ষে ফেরি চালানো কিংবা বর্ষাকালীন সময় পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাবে। সময়সূচি অনুযায়ী, উদ্বোধনের প্রথম তিন দিন উভয় দিকে দুবার করে ফেরি চলাচল করবে। এর পর থেকে দিনে একবার করে ফেরি চলাচল করবে। জোয়ার–ভাটার সময় অনুযায়ী ফেরি ছাড়ার সময়ও পরিবর্তিত হবে।

টিকিটের মূল্য ও যাত্রী সুবিধা

ফেরিতে যাতায়াতের জন্য নির্ধারিত ভাড়া হলো:

  • সাধারণ যাত্রী: ১০০ টাকা
  • মোটরসাইকেল: ২০০ টাকা
  • সিএনজি অটোরিকশা: ৫০০ টাকা
  • ব্যক্তিগত গাড়ি: ৯০০ টাকা
  • বাস: ৩,৩০০ টাকা
  • ট্রাক: ৩,৩৫০ টাকা
  • ১০ চাকার গাড়ি: ৭,১০০ টাকা

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান দৈনিক চট্টলার খবরকে বলেন, “এই ফেরি সার্ভিস সন্দ্বীপের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। এটি শুধু দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগই দৃঢ় করবে না, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষার প্রসার ও চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”

তাসু|ফখ|চখ

এই বিভাগের আরও খবর