chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

স্যুয়ারেজ ব্যবস্থায় পরিপূর্ণতা পাচ্ছে চট্টগ্রাম

৫০ বছর পর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার পথে চট্টগ্রাম ওয়াসা, ২০৩৫ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্য চট্টগ্রাম মহানগরীর স্যানিটেশন ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসা সুপেয় পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার দায়িত্ব পেলেও এতদিন শুধুমাত্র পানির সরবরাহ ব্যবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দীর্ঘ ৫০ বছর পর ওয়াসা প্রথমবারের মতো পরিকল্পিত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০১৭ সালে একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়, যেখানে চার দশকে ২৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এই পরিকল্পনার আওতায় চট্টগ্রাম মহানগরীকে ছয়টি ক্যাচমেন্টে ভাগ করে পর্যায়ক্রমে উন্নত স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম জানান, মহানগরীর প্রথম সুয়্যারেজ প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে ছয়টি ক্যাচমেন্টের মধ্যে পাঁচটির অনুমোদন পাওয়া গেছে, এবং খুব শিগগিরই কাজ শুরু হবে। পতেঙ্গা ক্যাচমেন্টটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) মডেলে বাস্তবায়িত হবে, যার জন্য কিছুটা সময় লাগছে। তিনি বলেন, “২০৩৫ সালের মধ্যে পুরো শহর স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার আওতায় আসবে এবং চট্টগ্রাম একটি পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যবান নগরীতে পরিণত হবে।”

হালিশহর স্যুয়ারেজ প্রকল্প (ক্যাচমেন্ট-১):

প্রথম পরিকল্পিত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা চট্টগ্রামের প্রথম স্যুয়ারেজ প্রকল্প হিসেবে ‘হালিশহর স্যুয়ারেজ প্রকল্প’ ২০১৮ সালে শুরু হয়, যা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য এই প্রকল্পের আওতায় নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬টি জোন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো হালিশহর ও আশপাশের এলাকায় উন্নত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। তবে প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পরই ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব আসে, যা প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি করেছে। চলমান কাজের মান ও স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, যা সংশ্লিষ্টদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। প্রকল্পটি আগামী বছরের দিকে কার্যক্রমে যেতে পারে।

কালুরঘাট ও বাকলিয়া স্যুয়ারেজ প্রকল্প (ক্যাচমেন্ট-২ ও ৪):

বৃহৎ পরিসরে উন্নত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বর একনেকে অনুমোদিত হয় ৫ হাজার ১৫২.৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কালুরঘাট ও বাকলিয়া স্যুয়ারেজ প্রকল্প’। এই প্রকল্পের মূল স্থাপনা কালুরঘাটের হামিদচরে একটি বৃহৎ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, যার দৈনিক তরল বর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা থাকবে ৬০ হাজার ঘনমিটার। প্রকল্পের আওতায় ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রধান স্যুয়ারেজ লাইন, ৭০ কিলোমিটার শাখা লাইন এবং ৭০ কিলোমিটার সার্ভিস লাইন নির্মাণ করা হবে। জামালখান, চকবাজার, চান্দগাঁও, বাগমনিরাম, শুলকবহর ও ষোলশহর এলাকায় বসবাসকারী মানুষ এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি উপকৃত হবেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১০ লাখ মানুষ উন্নত স্যুয়ারেজ সুবিধার আওতায় আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

উত্তর কাট্টলী স্যানিটেশন প্রকল্প (ক্যাচমেন্ট-৫):

তিন লাখ মানুষের জন্য উন্নত স্যানিটেশন সুবিধা ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ‘উত্তর কাট্টলী স্যানিটেশন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিচালিত এই প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলী এলাকায় উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা চালু করা হবে। এতে প্রায় ৩ লাখ মানুষ সরাসরি উপকৃত হবেন। ফ্রান্সভিত্তিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা (এফডি) প্রকল্পের অর্থায়ন করছে এবং কাজ দ্রুত শুরু হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ফতেহাবাদ স্যুয়ারেজ প্রকল্প (ক্যাচমেন্ট-৩):

দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থায়নে উন্নত নগর ব্যবস্থাপনা
ফতেহাবাদ এলাকাকে উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে ৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ফতেহাবাদ স্যুয়ারেজ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং ইতোমধ্যে সমীক্ষার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দৈনিক ৬০ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব হবে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ফতেহাবাদ এলাকার জলাশয় এবং নদীর দূষণ কমবে, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পতেঙ্গা স্যুয়ারেজ প্রকল্প (ক্যাচমেন্ট-৬):

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে বৃহৎ প্রকল্প
পতেঙ্গা এলাকায় উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা চালু করতে ৯ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পতেঙ্গা স্যুয়ারেজ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে জাপানের মারুবিনি কর্পোরেশন প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রতিদিন ৫০ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য পরিশোধন করা যাবে। বর্তমানে এটি পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন ও অন্যান্য সরকারি কমিটির পর্যালোচনার মধ্যে রয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও উদ্বেগ এই বিশাল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রথম প্রকল্প এখনো সম্পূর্ণরূপে শেষ না হলেও নতুন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, যা ব্যবস্থাপনাগত জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাছাড়া, প্রথম পর্যায়ের কাজের স্বচ্ছতা ও মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকল্পগুলোর মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ না করে একের পর এক প্রকল্প হাতে নিলে সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকারিতার অভাব দেখা দিতে পারে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:

২০৩৫ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা চট্টগ্রাম ওয়াসা ছয়টি বড় প্রকল্পের মাধ্যমে নগরীর স্যানিটেশন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত এসব প্রকল্প সম্পন্ন হলে ২০৩৫ সালের মধ্যে পুরো মহানগরী আধুনিক স্যুয়ারেজ নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হবে, পানিবাহিত রোগ হ্রাস পাবে এবং পরিবেশ দূষণ কমবে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে চট্টগ্রাম একটি পরিবেশবান্ধব, আধুনিক ও উন্নত নগরীতে পরিণত হবে।

স্যুয়ারেজ প্রকল্প নিয়ে শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। কেউ কেউ উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন, আবার কেউ কেউ নির্মাণ কাজের সময় সম্ভাব্য অসুবিধা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

এই বিভাগের আরও খবর