chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

মাছ ধরার কাঠের ট্রলার তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রামে

বঙ্গোপসাগরের কোঁলঘেষা সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল হতে দেশের সর্ব-উত্তরের মানুষের খাদ্যাভাসের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ। নানা ধরণের উৎসব, পালা-পর্বণ, বিয়েসহ সামাজিক সকল অনুষ্ঠানে লাক্ষ্যা-কোরালের মত জনপ্রিয় সব সামুদ্রিক মাছ বাঙালির পছন্দের শীর্ষে থাকে সবসময়। সমুদ্রের নীলাভ জলরাশি মাড়িয়ে মাছগুলো তুলে আনতে মৎস্য শিকারিদের কাছে যে যানটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং বহুলব্যবহৃত তা হলো কাঠের তৈরি ট্রলার

গভীর সাগরে মাছ ধরার ট্রলার নির্মাণের বাজার এত দিন পুরোটাই ছিল বিদেশনির্ভর। মূলত থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করে এই চাহিদা মেটানো হতো। তবে সময় পাল্টেছে। দেশীয় উদ্যোক্তারা এখন এগিয়ে এসেছেন। অত্যাধুনিক ফিশিং ট্রলার বা মাছ ধরার ট্রলার নির্মাণ করে পরীক্ষামূলকভাবে সাগরে ভাসিয়ে সফলতা দেখিয়েছেন চট্টগ্রামের কারিগররা।

প্রচলিত আছে ১৯ শতকের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডের ব্রিক্সহামে কাঠের তৈরি এক ধরণের পালতোলা নৌকার উদ্ভাবন হয়। উদ্ভাবনের কিছুদিনের মধ্যেই মাছধরার নৌকা হিসেবে ট্রলার ছড়িয়ে পরে দেশ হতে দেশান্তরে।

গাছের তৈরি এসব ট্রলার নির্মাণে চট্টগ্রামের ইতিহাসও বেশ সমাদৃত। ইউরোপের ভ্রমণকারী সিজার ফ্রেডারিক ১৫৬৭ সালে চট্টগ্রাম আসেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী পঞ্চদশ শতকে এ অঞ্চলের কাঠের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের মূল কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম। সপ্তদশ শতকে তুরস্কের সুলতানের নৌবহর তৈরি থেকে শুরু করে মুগল আমলে জাহাজ ও নৌকা তৈরির কাজে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পায় চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলি।

তবে সময়ের পরিক্রমায় এসব ট্রলার চালনায় আধুনিকতার ছোঁয়া দেখা গেলেও নির্মাণের সময় চোখে পড়ে পুরো উল্টো চিত্র।

  •  প্রাচীন রীতিতে নির্মাতার কারিগরি দক্ষতায় তৈরী হচ্ছে একেকটি সমুদ্রগামী ট্রলার। নগরের ফিশারিঘাট এলাকায় থেকে ছবি তুলেছেন এম ফয়সাল এলাহী

সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে নগরের ফিশারিঘাট এলাকায় এক দল কারিগরকে দেখা গেল রাঁদা, বাটালি, হাতুড়ি, বর্মা, করাতসহ নানা ধরণের আদি সরঞ্জাম নিয়ে কর্মব্যস্ত দিন পার করছেন। বড় কিংবা মাঝারি গড়নের এসব ট্রলারের গায়ে কেউ মাখছেন আলকাতরা, কেউ গাছের আকার পরিমাপ করছেন, কেউবা হাতুড়ি দিয়ে জোড়া লাগাচ্ছেন পাটাতন। আর যা হচ্ছে সম্পূর্ণ অনুমান ও কারিগরি দক্ষতার উপর ভিত্তি করে।

বড় ইঞ্জিনের একটি ট্রলারে সাধারণত ২০ থেকে ২৫ জন জেলে অবস্থান করে থাকে। যেখানে প্রতিটা বোটের সামনে ও পিছনের অংশে থাকে ধরণভেদে আলাদা আলাদা সংরক্ষণাগার। যার কোনটিতে সংরক্ষণ করা হয় মাছ, কোনটিতে জাল, বরফ, কিংবা সমুদ্রে টিকে থাকার জন্য খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সব উপকরণ। ইউ শেপের প্রতিটা ট্রলারের অগ্র-মধ্যভাগে দিকে থাকে ইঞ্জিনরুম ও কেবিন। যার উপরে বসে বিশালাকৃতির দাঁড় দিয়ে পুরো ট্রলারটি নিয়ন্ত্রণ করেন একজন মাঝি।

নগরের ফিশারিঘাট এলাকার হামিদ মিয়া নামে এক কারিগর বলেন, গেল ২৫ বছর যাবত আমি এ কাজের সাথে জড়িত আছি। দৈনিক ১২০০ টাকা মজুরিতে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করি। কোনো প্রকার হাতেখড়ি ছাড়াই হেলপার হিসেবে কাজে যোগ দিলেও এখন করতে করতে ধারনা হয়ে গেছে। এ ট্রলারগুলো বানাতে আমাদের কোনো নকশা বা ডকইয়ার্ডের প্রয়োজন হয় না। সমুদ্র কিংবা নদীর পাশে যেকোনো খালি জায়গায় বানানো সম্ভব এগুলো। প্রাচীনকাল থেকে এমনই হয়ে আসছে।

  • কারিগরা নিপুণ কৌশলে তৈরি করছেন ট্রলার। ছবি ফয়সাল এলাহী

তিনি আরো জানান, সমুদ্রগামী ট্রলারগুলো সাধারণত দৈর্ঘ্য ৫৬ ফুটের বেশি এবং প্রায় সাড়ে ১৬ ফুট প্রস্থের হয়।এছাড়া কাঠামো তৈরি ,ইঞ্জিন ও জালসহ প্রতিটি ট্রলার সমুদ্রে নামতে সময় লাগে প্রায় ৫ মাস, এতে খরচ হয় প্রায় ৮০ লক্ষ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত।

হোসেন মিস্ত্রি নামে আরেক কারিগর জানান, বর্ষা হচ্ছে মাছ ধরার ভরা মৌসুম।তাই এসময় ট্রলার তৈরি কিংবা মেরামত করা হয়না। এসব ট্রলার আমরা নদীর ধারে খোলা আকাশের নিচে তৈরি করি বিধায় ট্রলার তৈরি জন্য উপযুক্ত হলো শুষ্ক মৌসুম। বছরের সাত মাস নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত ট্রলার ও নৌকা তৈরি করা হয়।

একটি ট্রলার তৈরিতে বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করতে হয় জানিয়ে স্থানীয় কারিগররা জানান, সমুদ্রগামী একটি ট্রলার তৈরিতে প্রতিদিন পাঁচশ থেকে সাতশ শ্রমিক লাগে।  ট্রলার তৈরির প্রাথমিক কাজ শুরু করেন একজন কাঠ মিস্ত্রি। তারপর ভিন্ন ভিন্ন ধাপে ৩ থেকে ৫ মাস সময়ের মধ্যে তৈরি হয় এক একটি ট্রলার।

এমভি আল্লাহর দান নামে ট্রলারের মালিক সবুজ মিয়াঁ বলেন, আগে মালিকরা ট্রলার কিনতো মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে। তবে দেশে নির্মিত ট্রলারগুলো সাশ্রয়ী হওয়ায় এখন স্থানীয়ভাবে অনেকে ট্রলার তৈরি করছেন। এতে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান হচ্ছে এবং সাশ্রয়ী হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।

তিনি আরো জানান, সমুদ্রগামী ট্রলার তৈরিতে আমদানি করা লোহা কাঠ, চাপালিশ এবং ওক কাঠ ব্যবহার করা হয়। আর ছোট নৌকা তৈরিতে দেশীয় মেহগনি, চাপালিশ, রেইনট্রি কড়ই, নলকড়ই, পুনাল, নাড়াই, গর্জন, চাম্বল, ত্রিশূল শিশুগাছ ব্যবহৃত হয়।

পুরাতন কালুরঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সমুদ্রগামী দুইটি বড় ট্রলারকে নদীতে নামানোর প্রস্তুতি চলছে। ছোট ছোট অংশে ভাগ হয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। চলছে ইঞ্জিন বসানো ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজও।

শ্রমিকরা জানালেন, সমুদ্রগামী ট্রলারগুলো অনেক দ্রুতগতির হয়। উত্তাল সমুদ্রের প্রতিকূলে স্রোতের মাঝেও ঘণ্টায় ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার এবং অনুকূলে ঘণ্টায় ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে। চায়নাসহ বিদেশী আমদানি করা কোম্পানীর নতুন ও রিকন্ডিশন্ড ১৪০ থেকে ২৯০ হর্স পাওয়ারের শক্তিশালী ইঞ্জিন ট্রলার ও নৌকাতে বসানো হয়।

তাঁরা বলেন, যেদিন ট্রলার সমুদ্রে কিংবা নদীতে যায় সেদিন জেলেদের জন্য এক উৎসবের দিন। ট্রলারে আয়োজন হয় ধর্ম অনুযায়ী নানা প্রার্থনা। কারিগর এবং জেলেদেরকে ভালোভাবে একবেলা খাওয়ানো হয়। এছাড়া পুরস্কৃত করা হয় কারিগর ও মিস্ত্রিদের।

জেএফআই|ফখ|চখ

এই বিভাগের আরও খবর