চট্টগ্রামে বাড়ছে বায়ুদূষণ: স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নগরবাসী
ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও দিন দিন বাড়ছে বায়ুদূষণের মাত্রা। চট্টগ্রামের বায়ুদূষণ শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি।কল-কারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের অতিরিক্ত ধোঁয়া, নির্মাণকাজের ধুলাবালি এবং অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে নগরীর বাতাস দিন দিন দূষিত হয়ে উঠছে। এর ফলে বায়ুদূষণজনিত নানা রোগের প্রকোপও বাড়ছে।
চট্টগ্রামের বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হল শিল্প ও কল-কারখানার বর্জ্য। বিশেষ করে কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে অবস্থিত বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত ধোঁয়া ও রাসায়নিক পদার্থ বাতাসে মিশে যায়। পাশাপাশি শহরের ব্যস্ত সড়কগুলোতে যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত ধোঁয়া এবং ধুলাবালি বায়ুদূষণকে আরও তীব্র করছে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অব্যাহত নির্মাণকাজ এবং অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। নির্মাণকাজে ব্যবহৃত সিমেন্ট, বালি ও ইটের গুঁড়ো বাতাসে মিশে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রবেশ করছে।
বায়ুদূষণের কারণে চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, ফুসফুসের সংক্রমণ এবং হৃদরোগের মতো সমস্যা বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভোগা মানুষদের জন্য বায়ুদূষণ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দূষিত বায়ুতে দীর্ঘ সময় থাকার ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। তাছাড়া, বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম ধুলিকণা (PM2.5 ও PM10) ফুসফুসে জমে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফুসফুস বিশেষজ্ঞ ডা. মাহমুদ হাসান বলেন, “বায়ুদূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমরা প্রতিদিন হাসপাতালে শ্বাসকষ্ট ও বায়ুদূষণজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা বাড়তে দেখছি। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও গুরুতর। একমাত্র সচেতনতা ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই এই সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব।”
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র চিকিৎসক ডা. রাশেদুল করিম বলেন, “বায়ুদূষণের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ। দীর্ঘদিন দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়া মানুষের হৃদরোগ, ব্রঙ্কাইটিস ও ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। সরকার ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বায়ুদূষণ কমানোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।”
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সায়েম আহমেদ বলেন, “বায়ুদূষণ শুধু শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি করে না, এটি ত্বকেরও গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে একজিমা, অ্যালার্জি এবং ত্বকের অকাল বার্ধক্যের মতো সমস্যাগুলো বায়ুদূষণের কারণে বেড়ে যাচ্ছে।”
চট্টগ্রাম শিশু হাসপাতালের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শামীমা রহমান বলেন, “শিশুরা বায়ুদূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ে। বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের ফুসফুসের বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে এবং তারা দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে।যথাসম্ভব পিতামাতার উচিত শিশুদের পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত পরিবেশে রাখা।”
নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা মো. সোহেল বলেন, “আগে এত ধুলাবালি ছিল না। এখন রাস্তায় বের হলেই চোখ জ্বালাপোড়া করে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এটা ভীষণ কষ্টদায়ক।”
কাজীর দেউড়ি এলাকার গৃহিণী আনিমা আক্তার বলেন, “আমার ছোট ছেলে প্রায়ই ঠান্ডা-কাশিতে ভোগে। ডাক্তার বলেছেন, বায়ুদূষণের কারণে এটা হচ্ছে। আমরা বাসার জানালা বন্ধ রাখার চেষ্টা করি, কিন্তু পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব না।”
পাহাড়তলী এলাকার রিকশাচালক আব্দুল মালেক বলেন, “সারাদিন রাস্তায় থাকি, ধোঁয়া-ধুলার মধ্যে শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়। দিন শেষে মাথাব্যথা আর বুকে ব্যথা অনুভব করি। সরকারের উচিত এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।”
সমাধানের উপায়ঃ
১. শিল্প ও যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ: কল-কারখানাগুলোর জন্য নির্দিষ্ট বায়ু পরিশোধন ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা উচিত। পাশাপাশি যানবাহনের দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
২. নির্মাণকাজের মান নিয়ন্ত্রণ: নির্মাণকাজে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
৩. বৃক্ষরোপণ বৃদ্ধি: শহরের বিভিন্ন স্থানে গাছ লাগানোর মাধ্যমে বাতাসের মান উন্নত করা সম্ভব।
৪. বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতি: সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাতাসে ক্ষতিকর উপাদান ছড়ানো রোধ করা যেতে পারে।
চখ/মীম