চট্টগ্রামে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ
চট্টগ্রাম নগরীসহ জেলাজুড়ে ধীরে ধীরে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। চট্টগ্রামে ধীরে ধীরে এডিস মশার কামড়ে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হচ্ছে রোগীদের। কেউ কেউ বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। অবশ্য ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে এখনো গত বছরের মতো প্রকট হয়নি। তবে বিপদ দূর হয়নি, কেননা এডিস মশার প্রজননের মূল মৌসুম শুরু হচ্ছে চলতি জুলাই মাসে। চলবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। গত বছরের বিপর্যয় মাথায় রেখে এখনই মশা নিধন কার্যক্রমে জোর দেওয়া উচিত বলে চিকিৎসকেরা মত দিলেও সিটি করপোরেশনের এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
এবার নগরীর চেয়ে উপজেলা পর্যায়ে প্রকোপ বেশি দেখা যাওয়ার তথ্য দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, নগরীর চেয়ে এবার উপজেলায় ডেঙ্গু রোগী প্রায় তিনগুণ বেশি। এর মধ্যে লোহাগাড়া উপজেলার এমচরহাট বাজার ঘিরে সবচেয়ে বেশি রোগীর কথা জানা যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেছেন, “ওই এলাকা ঘিরে প্রকোপ বেশি, এটা সত্য। কারণ অনুসন্ধানে আমাদের কীটতত্ত্ববিদ সেখানে যাবেন।”
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ের প্রথম ১৩ দিনে চট্টগ্রাম জেলায় ৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫৬ জনই বিভিন্ন উপজেলার এবং ১৭ জন নগরীর বাসিন্দা।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ২৫।
বর্ষার শুরু থেকে বাড়ছে আক্রান্ত
এবার এখনও ২০২৩ সালের চেয়ে চট্টগ্রাম জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কম। তবে বর্ষার শুরু থেকে ডেঙ্গুর প্রবণতা বাড়তে দেখা যায়। পুরো জুনের তুলনায় জুলাইয়ের প্রথম ১৩ দিনে রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ বলছেন, আগের বছরের চেয়ে রোগী কম হওয়ায় সন্তুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শনিবার ১৩ জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলায় মোট ৮১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। অথচ পুরো জুনে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪১ জন।
আগের বছর পুরো জুলাইয়ে চট্টগ্রামে ২ হাজার ৩১১ জন এবং জুনে ২৮৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সে তুলনায় এবার আক্রান্তের হার অনেক কম।
চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মহানগর বাদে চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলায় ২৭১ ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে লোহাগাড়ায় সর্বোচ্চ ৬২ জন আক্রান্তের তথ্য দিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়।
জুনে লোহাগাড়ার পুটিবিলা ইউনিয়নের এমচরহাট বাজার ঘিরে বসতবাড়িতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা যে কোনো বছরের তুলনায় খুবই বেশি বলে তথ্য আসছে।
- পুটিবিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মানিক বলেন, “এমচরহাট বাজারের ৫০০ গজ দূরত্বের মধ্যে দোকানপাট, ঘরবাড়ি ও স্থাপনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়, যেখানে পুরো উপজেলাতেও এত মানুষ আক্রান্ত হয়নি।
“উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং আমরা মিলে সবাইকে সচেতন করছি। এখন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা একটু কমেছে।”
লোহাগাড়া স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হানিফ বলছেন, “সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়ার পর এমচরহাটে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে শুরু করেছে। তবে প্রকোপ কেন এবার বেশি, সেটি জানতে কাজ চলছে।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে সেখানকার পরিস্থিতি জানতে চাইলে, তাদের কেউ কেউ বলেছেন, জুন থেকে জুলাইয়ের ১৩ তারিখ পর্যন্ত এমচরহাট ঘিরে প্রায় তিন শতাধিক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের বেশিরভাগই বাড়িতে অবস্থান করে এবং বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছেন।
ডা. হানিফ বলছেন, “এমচরহাট বাজার ঘিরে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি জেনে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। বাজারকে কেন্দ্র করে কয়েকটি ডোবা আছে। ময়লা-আবর্জনা জমেছিল কিছু জায়গায়।
“সেগুলো পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়ার পর রোগীর সংখ্যা এখন কমতে শুরু করেছে।গতকাল (শনিবার) তিনজন ভর্তি হয়েছেন।”
তিনি বলেন, তবে জুনে এমচরহাট বাজারের আশপাশের প্রায় প্রতি বাড়িতেই জ্বরে আক্রান্ত মানুষের তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল। এখন পর্যন্ত শ’তিনেক মানুষ জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন বলে তথ্য এসেছে। তাদের বেশির ভাগই বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন।
সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ বলছেন, “এমচরহাট ঘিরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি, এটা সত্য। তবে কোন প্রতিষ্ঠান বা বাজার ঘিরে ছড়াচ্ছে, ডেঙ্গুর বেলায় সেটি নির্দিষ্ট করে বলার সুযোগ নেই। নানা কারণে সেখানে প্রকোপ বেশি হতে পারে। কারণ জানতে আমাদের কীটতত্ত্ববিদ সেখানে যাবেন।”
জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদাওছ বলেন, “একটি এলাকা ঘিরে এত ডেঙ্গু রোগীর যে বিষয়টি বলা হচ্ছে, তা যাচাই করতে হবে। সেখানে বেশিরভাগ জ্বরাক্রান্ত মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে গিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। টেস্টে তাদের ডেঙ্গু আক্রান্ত বলা হয়েছে কি না, অথবা টেস্ট না করিয়েই বলা হচ্ছে, সেসব আগে জানতে হবে।”
চিকিৎসার জন্য নেই আলাদা ইউনিট
নগরীর বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আক্রান্ত বাড়লেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নেওয়া হয়নি পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। রোগীদের জন্য চিকিৎসার জন্য নেই আলাদা ইউনিট। সাধারণ রোগীদের সঙ্গে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এতে অন্যদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে।
ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গু চিকিৎসায় আমাদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার প্রস্তুতি আছে। এটি মশাবাহিত রোগ। ডেঙ্গু দমন করতে হলে এডিস মশা মারতে হবে। এর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।’
তিন বছরের মধ্যে গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি একেবারেই আমাদের সব ধারণাকে ছাড়িয়ে গেছে উল্লেখ করে সিভিল সার্জন আরও বলেন, ‘আমরা যদি সচেতন না হই, তাহলে এই পরিস্থিতি এবারও খারাপ হবে।’
মশকনিধন কার্যক্রম বন্ধ
গত বছর ঢাকঢোল পিটিয়ে মশকনিধনে নানা কর্মসূচি পালন করেছিল সিটি করপোরেশন। এবার তেমন কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে না। অথচ এডিস মশার প্রজননের মূল মৌসুম শুরু হয়েছে চলতি জুলাই মাস থেকে। চলবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। গত বছরের বিপর্যয় মাথায় রেখে মশানিধন কার্যক্রমে জোর দেওয়া উচিত বলে চিকিৎসকরা মত দিলেও সিটি করপোরেশনের কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি নগরবাসীর।
নগরীর পাঁচলাইশ থানার হামজারবাগ সঙ্গীত এলাকার বাসিন্দা মো. ইউসুফ তালুকদার বলেন, ‘এডিস মশার উপদ্রব বাড়লেও সিটি করপোরেশনের কর্মীদের ওষুধ ছিটানোর কোনও কার্যক্রম চোখে পড়ছে না আমাদের। সঙ্গীত আবাসিক এবং মফজল আহমদ মসজিদ এলাকায় গত এক বছরে সিটি করপোরেশনের কেউ মশার ওষুধ ছিটিয়েছে এ রকম দৃশ্য চোখে পড়েনি। গত বছর এই এলাকায় বিপুল সংখ্যক লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। এরপরও সিটি করপোরেশন ওষুধ ছিটানোর ওপর জোর দিচ্ছে না। কেন দিচ্ছে না, তা জানি না।’
একই কথা বলেছেন নগরীর দেওয়ানবাজার শান্তিরবাগের বাসিন্দা মো. রফিকুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমার এলাকায় গত ছয় মাসে সিটি করপোরেশনের কোনও কর্মীকে মশানিধনের জন্য ওষুধ ছিটাতে দেখিনি। গত বছর অনেকে আক্রান্ত হয়েছিল। এবারও আক্রান্ত হচ্ছে। এরপরও মশানিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম নেই।’
কেন বন্ধ কার্যক্রম?
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম মাহী বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম চলমান আছে। গত বছরের চেয়ে এবার প্রস্তুতি ভালো। সিটি করপোরেশনের কাছে ২০ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইড ও তিন হাজার লিটার ফরমুলেশনবিহীন লার্ভিসাইড (লার্ভা মারার ওষুধ) মজুত আছে। ১৬ হাজার লিটার এলডিইউ (কালা তেল) মজুত আছে। ভেষজ ওষুধ ‘মসকুবার’ মজুত আছে ৮০০ লিটার।’
অনেকে বলেছেন তাদের এলাকায় ওষুধ ছিটাতে কাউকে দেখেননি এমন প্রশ্নের জবাবে শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘মশকনিধন কার্যক্রমে গতি আনার জন্য নতুন করে ৬০টি ফগার মেশিন ও ১০০টি স্প্রে মেশিন কেনা হয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে সিটি করপোরেশনের কাছে ১৫০টি ফগার মেশিন এবং ২৫০টি স্প্রে মেশিন রয়েছে। মশকনিধন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৪০০ জন আছে। পর্যায়ক্রমে সব এলাকায় ছিটানো হবে।’
ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধের কথা বললেন মেয়র
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গুরোধে সম্মিলিতভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে করোনার মতো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নগরীর প্রত্যেক সংস্থা, সামাজিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন সোসাইটির নেতৃবৃন্দ, মসজিদে জুমার নামাজে মাধ্যমে নাগরিকদের সচেতন করতে পারলে করোনার মতো ডেঙ্গুও প্রতিরোধ সম্ভব হবে।’
মেয়র আরও বলেন, ‘আমাদের চারপাশে যেসব জায়গায় এডিস মশা জন্মায় সেসবে যাতে জন্মাতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। নালা-নর্দমায় এডিস মশা জন্মায় না। পরিষ্কার ও বদ্ধ পানি প্রজননক্ষেত্র। তাই বাসাবাড়ির আশপাশে ডাব, নারকেলের খোসা, প্লাস্টিকের বোতল, ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, ছাদবাগান ও জমানো পানি তিন দিনের বেশি যাতে জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
মআ/চখ