চট্টগ্রামের ১৭টি নদী সংকটাপন্ন
প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, দেশের ২২৯টি নদী সংকটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এরমধ্যে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ১৭টি নদীর অবস্থা খুব খারাপ। চট্টগ্রামের হালদা, সাঙ্গু, কাপ্তাই লেক, নাফনদী, শঙ্খনদীসহ বাকি নদীগুলো দখলে,দূষণে মরতে বসেছে।
বাংলাদেশে পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল জাতীয় নদী সম্মেলনে তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, এসব নদী এখনই দখল ও দূষণমুক্ত করা যাবে না। তবে সরকার ও সবাই মিলে চাইলে ৬৪টি জেলার একটি করে নদীকে দুই বছরের মধ্যে দখল ও দূষণমুক্ত করা সম্ভব।
তিনি জানান, সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি নদী সংকটাপন্ন রংপুর বিভাগে, ৪৩টি। তা ছাড়া সিলেটের ৪২টি, খুলনায় ৩৭টি, বরিশালে ৩০টি, ঢাকায় ২৮টি, রাজশাহীতে ১৯টি, চট্টগ্রামে ১৭টি ও ময়মনসিংহে ১৩টি নদী সংকটাপন্ন।
তিনি বলেন, সবাইকে নিয়ে নদী রক্ষা করতে হবে। দেশের সব নদীর তথ্যভান্ডার তৈরি করতে হবে, যাতে প্রতিবছর নদী রক্ষায় কী অগ্রগতি হলো, তা পর্যবেক্ষণ করা যায়। আর দেশের পরিবেশ, বন্য প্রাণীসহ নানা প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় যেমন আইন আছে, নদী সুরক্ষায় তেমন একটি আইন করতে হবে।
নদী দখলমুক্ত করতে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে উল্লেখ করে অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের অনেক সমস্যা আছে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ। বালুর লোভ তো আমিও সামলাতে পারি না। কাকে দোষ দেব আমি।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী আরও বলেন, ‘নদী দখলকারীরা অপরাধী। এরা কখনো আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির হতে পারে না। সরকার তাদের অপরাধী হিসেবেই দেখে। আমরা এই জায়গায় জিরো টলারেন্স। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আমাদের কাজ করতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই না অপরাধী, দখলদার ও দূষণকারীদের হাতে দেশের এত বড় গর্বের জায়গা নদীগুলো পরাজিত হোক। নদী রক্ষায় আমাদের সংগ্রাম চলবে।’
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান সারোয়ার মাহমুদ বলেন, কারও একার পক্ষে নদী রক্ষা করা সম্ভব নয়। যাঁরা নদী রক্ষায় আন্দোলন করছেন, তাদের নিয়ে সরকার নদী সুরক্ষার পরিকল্পনা করছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নদী আন্দোলনের সংগঠক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘একমাত্র নদী দখলের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা একজোট হয়ে যান। যাঁরা নদী রক্ষার কথা বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মাঠে নামেন। এতে দেশের নদী রক্ষা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, দেশের নদীগুলো থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে নদীর পাড় ভাঙ্গাসহ নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বালুমহাল ইজারা দেওয়ার নামে নদীগুলোকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এগুলো এখনই বন্ধ করতে না পারলে অনেক নদী দ্রুত মারা যাবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, শুধু আইন দিয়ে নদী দখল প্রতিরোধ সম্ভব নয়। দেশের নদী রক্ষার বিষয়ে কাজ করার আগে নদীর ধরন সম্পর্কে জানতে হবে, বুঝতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘নদী শুধু নৌপথ নয়, এটি আমাদের কৃষি, জীবনযাপন ও প্রাণপ্রকৃতির সবচেয়ে বড় আধার। তাই নদী রক্ষার বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে চিন্তা করতে হবে।’
দখল-দূষণে মরতে বসেছে কর্ণফুলী
একের পর এক দখলবাজের কবলে ও নানা রকম বর্জ্যরে সংমিশ্রণে, অব্যবস্থাপনায় মরতে বসেছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কর্ণফুলী নদী। এর ফলে একদিকে যেমন ঘটছে পরিবেশ বিপর্যয়, মরছে নানা প্রজাতির মাছ, ভরাটের কবলে পড়ে বিঘ্নিত হবে নৌ চলাচলেও। এসব দেখবালের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা এমনভাবে আছেন যেন এই নদী মরে গেলেও কারো কিছু এসে যায়না অবস্থাদৃষ্টে এমনটি মনে করছেন সংলিষ্টরা।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের একটি জরিপে বলা হয় , ’২০০০ সালে কর্ণফুলী সেতুর কাছে নদীর প্রস্থ ছিল ৯৩০ মিটার, তা বর্তমানে রয়েছে ৪১০ মিটার। ফ্যাদোমিটারের মাধ্যমে ভাটার সময় নদীর গভীরতা পরিমাপ করা হয়। তাতে চর পাথরঘাটা ব্রিজঘাট থেকে উত্তর পাশে গভীরতা পাওয়া যায় ২৫ ফুট। চাক্তাই খালের মোহনায় নদীর গভীরতা মিলেছে মাত্র দুই ফুট। ওই জায়গায় চর জেগেছে। রাজাখালী খালের মোহনায় পাওয়া গেছে চার ফুট। কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর ৩ নম্বর পিলারের কাছে গভীরতা প্রায় ৬১ ফুট। আবার ৫ নম্বর পিলারের কাছে গভীরতা ৭৮ ফুট পাওয়া যায়।
২০২২ সালে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অপরিকল্পিত খনন এবং চাক্তাই খালের মাছ বাজারকে নদীর অংশ ইজারা দেওয়ার কারণে নদীর প্রশস্ততা ও গভীরতা কমেছে। নদীর প্রবাহের এলাকা কমে যাওয়ার কারণে সেতুর পিলারের নিচে নদীর তলদেশের মাটিতে ছোট-বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। এটা সেতুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া কয়েকটি পিলারের গোড়ার মাটি সরে যাচ্ছে বলেও তাঁরা জানান।
কর্ণফুলী রক্ষায় পরিকল্পিত খনন করা, নদীকে অবৈধ দখলমুক্ত করা, ইজারা বন্ধ করা, ময়লা আবর্জনা না ফেলাসহ নানা সুপারিশ করেছে নদী রক্ষা আন্দোলন।
বন্দর নগরীর অর্থনীতির চালিকাশক্তি এই কর্ণফুলী নদী। দূষণে এ নদীকে ধীরে ধীরে গলাটিপে মেরে ফেলা হচ্ছে বলে পরিবেশবাদীদের জোর দাবি। এ নদীর দূষণরোধে শিল্প কলকারখানায় ইটিপি স্থাপনের তাগিদ সরকার প্রধানের। কেননা, কর্ণফুলী নদী মরলে চট্টগ্রামও মরবে। এমনকি নদী সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, প্রধানমন্ত্রীর কড়া বার্তার পরে কর্ণফুলীর দখল ও দূষণমুক্ত করার কার্যক্রমে গতি আসবে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে নদীতে পলি জমে কর্ণফুলী নদীর বুকে চর জেগেছে। ফলে, জাহাজ চলাচলে হুমকির মুখে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল।
আর বহাল তবিয়তে এখনো দুই পাড়ে রয়ে গেছে দুই হাজার অবৈধ স্থাপনা। প্রতিনিয়ত কলকারখানার রাসায়নিক ও গৃহস্থালির বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাণ কর্ণফুলী নদী নানামুখী দখল আর দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে মরতে বসেছে।
রাসায়নিক দূষণ থেকে নদীকে রক্ষায় শিল্প কারখানায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব নেই কারো। এ ছাড়া দূষণ বহুগুণ বাড়াচ্ছে ৬০ লাখ নগরবাসীর গৃহস্থালির বর্জ্য। নদীটিকে বাঁচাতে যেমন জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা রাখা দরকার, ততটা নেই তাঁদেরও। দু’পাড়ের অনেকেই বলেছেন, উচ্ছেদ করে লাভ কী, পরে যদি আবারো দখল করে।
দখল ও দূষণের কবলে হালদা
এশিয়া মহাদেশের একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী দূষনের শিকার হচ্ছে চরম ভাবে। এ অবস্থা রোধ করা না গেলে অচিরেই এ নদী মৃত নদীতে পরিণত হবে। জানা যায়,দেশের একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র এ হালদা নদী।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, হালদা নদীর রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারি ও ফটিকছড়ি অংশ এখন দখল আর দূষণের কবলে পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছে। বিষাক্ত বজ্যে’র অত্যাচারে শীতল হালদা এখন আর বিশুদ্ধ বাতাস দিতে পারছেনা হালদা পাড়ের মানুষগুলোকে।
একশ্রেণির একশ্রেণীর দখলবাজদের কবলে পড়ে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে হালদার প্রস্থ। বাঁশের দোকান বা বাঁশ স্টক করা, লাকড়ির দোকান, গাছের স্টকসহ নানা অজুহাতে দিন দিন হালদাকে গ্রাস করছে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। এতে করে হালদার অস্তিত্ব অনেকটা বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
- ফখ|চখ