অব্যবস্থাপনায় ধ্বংসের পথে কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য ভাণ্ডার!
রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
এক সময় মৎস্য সম্পদে ভরপুর ছিল পার্বত্য রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। হ্রদের বড় বড় মাছ আকৃষ্ট করতো সবাইকে। কিন্তু সেসব এখন কেবলই পুস্তিকায় লিপিবব্ধ গল্প। হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্রগুলো অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। আগের মতো প্রাকৃতিক প্রজনন হচ্ছে না কার্প জাতীয় মাছের।
শুধু তা-ই নয়, বিলুপ্তি ঘটছে মিঠা পানির অনেক প্রজাতির মাছের। যেগুলো এক সময় এ হ্রদে প্রাকৃতিকভাবে প্রজনন হতো। আর তা আহরণের মধ্য দিয়ে সরকারি কোষাগারে জমা হত কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। যদিও প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে কার্প জাতীয় মাছের পোনা ছাড়ছে সংশ্লিষ্ট হ্রদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ। তবে সেই রাজস্ব আয় আর নেই!
সংশ্লিষ্টরা জানান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলাধার ও বাংলাদেশের মিঠাপানির অন্যতম প্রধান মৎস্য উৎপাদনস্থল রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। এ হ্রদ বাংলাদেশের বদ্ধ জলাশয় সমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং মিঠাপানির মাছের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। এ হ্রদের আয়তন ৬৮৮০০ হেক্টর এবং এর জলায়তন ৫৮,০০০ হেক্টর যা আভ্যন্তরিণ জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ।
কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপনন কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অভিযোগ, কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের রাঙামাটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে হ্রদটি আজ ধ্বংসের পথে। যদিও এই নিয়ে টু-শব্দ করার সাহস পান না কেউই।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, বিলুপ্তির পথে থাকা মাছগুলোর অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে হ্রদ খননসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে গত কয়েক বছর ধরে সরকারকে সুপারিশ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। যদিও সেগুলো বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। কাপ্তাই হ্রদ মৎস উন্নয়ন ও বিপনন কেন্দ্রের সরকারি গাড়ী ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার হচ্ছে চট্টগ্রামে। পছন্দের লোককে দেওয়া হয় পদায়ন-পদোন্নতি বা সংযুক্তিতে বদলী। রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় দিবসগুলোতে সরকারি কর্মসূচিতে (অনুষ্ঠানে) কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতি। এমন সব অনিয়ম ও সেচ্ছাচারিতার কারণে সংস্থাটি ভেতরে বাহিরে নানান সমস্যায় র্জজরিত। অন্যদিকে রহস্যজনক কারণে দিন-দিন বিপুল পরিমান রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ভাষ্য, চলতি মৌসুমে পানি বেশি থাকার কারণে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে বেশ ভালোই মাছ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে রাঙামাটি সদর সৎস অবতরণ কেন্দ্রে আহরিত মাছ থেকে বিগত বছরগুলোর তুলনায় কয়েকগুন বেশি রাজস্ব আয় করেছে। লংগদু, মহালছড়ি ও কাপ্তাই উপজেলাধীন কাপ্তাই মৎস অবতরণ কেন্দ্রেও একইভাবে রাজস্ব আয় হওয়ার কথা। তবে রহস্যজনক কারণে বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবছর কাগজে-কলমে রাজস্ব কমেগেছে এই তিন মৎস অবতরণ ও বিপনন কেন্দ্রে।
তাদের অভিযোগ, বিএফডিসির ব্যবস্থাপক রাঙামাটি সদর মৎস অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা কমিটি করে দিয়েছেন। যার কারণে এই কেন্দ্রে সকল ধরণের আয়-ব্যয় হিসাব যথাযথভাবে লিপিবব্ধ হওয়ার কারণে সরকারী কোষাগারে বিপুল পরিমান রাজস্ব জমা হয়েছে। তবে রহস্যজনক কারণে লংগদু, মহালছড়ি ও কাপ্তাই উপজেলাধীন মৎস অবতরণ কেন্দ্রে কোনো কমিটি করা হয়নি। আর এই সুযোগে আহরিত মাছ থেকে আদায়কৃত রাজস্বের অর্থ নয়-ছয়ে চলে গেছে বিভিন্ন জনের পকেটে।
রাঙামাটি বিএফডিসি সূত্রে জানাগেছে, হ্রদের মাছ থেকে রাজস্ব আদায় করে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)। বিএফডিসি বর্তমানে যে মাছ থেকে রাজস্ব আদায় করছে তার ৯২ ভাগই হল ছোট মাছ। যেগুলো কেচকি, চাপিলা আর মলা মাছ।
বিএফআরআই’র গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ছোট মাছের উৎপাদন বাড়লেও বিপরীতে কমছে কার্প জাতীয় মাছ।
বিএফডিসি’র তথ্য মতে, ১৯৬৫ সালে কাপ্তাই হ্রদ থেকে বাণিজ্যিকভাবে মাছ আহরণ শুরু হয়। ১৯৬৫-৬৬ অর্থ বছরে আহোরিত মাছের মধ্যে ৮১ ভাগ ছিল কার্প জাতীয় আর ১৯ ভাগ ছিল ছোট মাছ।
বর্তমানে এ কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন কমে দাড়িয়েছে ৫ ভাগে। আর ছোট মাছের উৎপাদন ৯৫ ভাগ। ক্রমান্বয়ে ছোট মাছ বাড়ছে আর কার্প জাতীয় মাছ কমছে।
রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ মৎস উন্নয়ন ও বিপনন কেন্দ্র কর্মচারি ইউনিয়নের সহসভাপতি মো. আলাউদ্দিন বলেন, রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ মৎস উন্নয়ন ও বিপনন কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের নানান অভিযোগ-অনুযোগ রয়েছে। এসব নিয়ে বিভিন্ন সময় আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আবেদন নিবেদন করেছি। সরকারি রাজস্ব আদায় এবং সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরী হয়ে পড়েছে। না হয় দেশের মৎস্য সম্পদের ভান্ডারটি চিরতরে নষ্ট হয়ে যাবে বলে আশংকা করছেন কর্মজীবীদের এই নেতা।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মৎস উন্নয়ন কর্পোরেশন, রাঙামাটির ব্যবস্থাপক মো. আশ্রাফুল আলম বলেন, কি জানতে চান হোয়াটস্অ্যাপে লিখে পাঠান। পরে তার আর কোনো বক্তব্য মিলেনি।
বাংলাদেশ মৎস উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার ও সচিব মো. হারুন অর রশিদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করে কোনো পাওয়া যায়নি।
ফখ|চখ