chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

স্বপ্ন ছুঁয়েছে চট্টগ্রামের উন্নয়ন প্রকল্প

চট্টগ্রামকে উন্নতির দ্বারপ্রান্তে নিতে একের পর এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করছে বর্তমান সরকার। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে প্রকল্পগুলোর মেগা প্রকল্প। বাস্তবায়নে স্বস্তি ফিরেছে বৃহত্তর চট্টগ্রামে জনজীবনে।

বিদায়ী ২০২৩ সালেও চট্টগ্রামে স্বপ্ন ছুঁয়েছে বেশ কিছু প্রকল্প। এসবের মধ্যে ছিল বঙ্গবন্ধু টানেল, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-কক্সবাজার রুটে রেল, মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু ইকোনমিক জোন এবং বহু মডেল মসজিদ নির্মাণসহ বেশ কিছু প্রকল্প।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল 

চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর বহুল প্রত্যাশিত চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম যোগাযোগ পথ টানেলের ফলক উন্মোচন করা হয়। এটি উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নদীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম সড়ক টানেল এটি। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের খননকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় । নির্মাণকাজ শুরুর প্রায় সাড়ে চার বছর পর টানেলের উদ্বোধন করা হয়। টানেলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর গাড়ি চলাচল শুরু হয় ২৯ অক্টোবর সকাল ৬টা থেকে। দেশের প্রথম টানেলের সংযোগ সড়কসহ মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার প্রধান টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এ ছাড়া সংযোগ সড়ক ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার লম্বা। আনোয়ারা প্রান্তে থাকা একমাত্র ভায়াডাক্ট বা ওভারপাস ৭২৭ মিটার দীর্ঘ। টানেলের ভেতরে থাকা দুটি টিউব বা সুড়ঙ্গের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন রয়েছে। দেশের প্রথম এ টানেল নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ এবং চীন সরকারের আর্থিক সহায়তায় । বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে খরচ হচ্ছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আর চীন সরকার ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা। চীন সরকার এ সহায়তা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে। এ ঋণ সুদসহ ফেরত দিতে হবে।

এ ছাড়া টানেলের আগামী পাঁচ বছরের জন্য রক্ষণাবেক্ষণ এবং টোল আদায়ের দায়িত্বও পেয়েছে প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেড । তাই এ প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে ৯৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে চারটি স্ক্যানার কেনা এবং স্থাপনের কাজে।

মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর চ্যানেল :

এ বছরের ১১ নভেম্বর কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে বহুল প্রতীক্ষিত দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে এ চ্যানেলে কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এ বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির গেম চেঞ্জার হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। জোয়ার-ভাটায় যে কোন সময়ে ৮ হাজার টিইইউএস’র জাহাজ ভিড়তে পারবে এখানে। ফলে আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনগুলোর জন্য বাংলাদেশে জাহাজ নিয়োজিত করার সুবিধা বাড়বে। এতে পণ্য পরিবহনে খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। এ বন্দরকে ঘিরে মাতারবাড়ী-মহেশখালী এলাকায় ব্যাপক শিল্পায়নসহ গড়ে উঠবে অর্থনৈতিক অঞ্চল । ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকসহ পেশাজীবীদের জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশের বেকার সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে এ বন্দর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৬ সালে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ বন্দরের মাধ্যমে ২০২৬ সালের মধ্যে আনুমানিক ০.৬ থেকে ১.১ মিলিয়ন টিইইউস (বিশ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনার) এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আনুমানিক ২.২ থেকে ২.৬ মিলিয়ন টিইইউস কন্টেইনার কার্গো হ্যান্ডেল করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। মাতারবাড়ী বন্দরকে কেন্দ্র করে এখানে বাণিজ্যিক হাব গড়ে তোলা হবে। চট্টগ্রাম বন্দর যেমন দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন, তেমনি মাতারবাড়ী বন্দরও দেশের অর্থনীতির জন্য আরেকটি প্যারালাল লাইফ লাইনে
পরিণত হবে বলেও আশা করা হচ্ছে।

ঢাকা-কক্সবাজার রুটে রেল :

গত ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার রেল সংযোগ উদ্বোধন করেন। এ সময় ডিসেম্বর থেকে দুটি ট্রেন চালুর নির্দেশ দেন তিনি এরপর ১ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ ঢাকার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে যায়। রাত ৯টা ১০ মিনিটে এই ট্রেন ঢাকায় পৌছায়। ফিরতি ট্রেন কক্সবাজারের উদ্দেশে ঢাকার কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে যায় রাত সাড়ে ১০টায়।

এ রুটে ট্রেনের গতিসীমা ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলো মিটার নির্ধারণ করা হয়েছে। কয়েক দফা পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচলের সফল কার্যক্রম শেষে গত ১১ নভেম্বর কক্সবাজার রেল সংযোগ উদ্বোধন করা হয়। এ রুটে ট্রেন চলাচলকে কেন্দ্র করে পর্যটকসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করা গেছে। কক্সবাজারে পর্যটনশিল্পের জন্য তৈরি হয়েছে নতুন সম্ভাবনা।
এ রুটে আপাতত দুটি ট্রেন চলাচল করছে। ট্রেনের সর্বনিম্ন ভাড়া যেটি ধরা হয়েছে সেটি হচ্ছে ১৮৮ টাকা। আর এটি নন এসি মেইল ট্রেন। সর্বোচ্চ ভাড়া এসি বার্থে ১ হাজার ৭২৫ টাকা। বর্তমানে রেলের যে ভাড়ার হার আছে সেই অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়েছে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, নতুন এই ট্রেনে মোট ১৬টি কোচ রয়েছে। আসন রয়েছে ৭৮০টি। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত শোভন চেয়ারের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৯৫ টাকা। এসি চেয়ারের ভাড়া ১ হাজার ৩২৫ টাকা, এসি সিটের ভাড়া ১ হাজার ৫৯০ টাকা এবং এসি বার্থের ভাড়া (ঘুমিয়ে যাওয়ার আসন) ২ হাজার ৩৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত শোভন চেয়ারের ভাড়া ২০৫ টাকা, স্নিগ্ধা শ্রেণির ৩৮৬ টাকা, এসি সিটের ৪৬৬ এবং এসি বার্থের ভাড়া ৬৯৬ টাকা নির্ধারণ
করা হয়।

চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স

২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স। এটি দেশের অন্যতম বৃহৎ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নতুন গতি আসবে। ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সটি উদ্বোধন করেন।

চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হল ও বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার সংস্কার করে পরিধি বাড়ানোর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল চট্টগ্রামের সংস্কৃতি কর্মীসহ সব মহলের। অবশেষে সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবরূপ লাভ করছে। ২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের অধীনে আগের জরাজীর্ণ ঐতিহ্যবাহী মুসলিম হল ভেঙে করা হয়েছে আটতলা নতুন ভবন। এর সঙ্গে লাগোয়া পুরোনো গণগ্রন্থাগার (পাবলিক লাইব্রেরি) ভেঙে করা হয়েছে ১৫ তলা ভবন। দুটি স্থাপনাই এখন নগরীর অন্যতম দৃষ্টিনন্দন স্থাপনায় পরিণত হয়েছে।প্রকল্পের আওতায় ১৫২১২.২৮ বর্গফুট জায়গায় ১৫ তলা বিশিষ্ট ১টি চট্টগ্রাম বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগার, ১৪৪৯৩.২২ বর্গফুট আয়তনের ১টি মাল্টিপারপাস হল ও সেমিনার হলের পাশাপাশি ৭৪১৩.৬০ বর্গফুট আয়তনের জনসমাগম স্থান তৈরি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পুনঃসংস্কার কাজ। মূল সড়কের দুই পাশে যাতায়াতে তৈরি হয়েছে টানেল। গণগ্রন্থাগার ভবনের নিচতলায় থাকছে সার্ভিস সেকশন, যেখানে বই বাছাই, ফিউমিগেশন হবে। গ্রাউন্ড ও প্রথম ফ্লোরে থাকছে অফিস,২য় ফ্লোরে সেমিনার ও মিটিং রুম, প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ থাকবে তৃতীয় ফ্লোর। চতুর্থ ও পঞ্চম ফ্লোরে জেনারেল লাইব্রেরি, ষষ্ঠ ফ্লোরে চিলড্রেন লাইব্রেরি, সপ্তম ফ্লোরে পেপার লাইব্রেরি, অষ্টম ফ্লোরে রেফারেন্স লাইব্রেরি, নবম ও দশম ফ্লোরে সায়েন্স লাইব্রেরি, ১১তম ফ্লোরে ট্রেনিং ইউনিট, ১২তম ফ্লোরে আইসিটি ইউনিট, ১৩তম ফ্লোরে স্পেস ফর ফিউচার প্রোভিশন, ১৪তম ফ্লোরে গেস্ট হাউজ নির্মাণ করা হচ্ছে।এছাড়া ৪০ থেকে ৫০ আসন বিশিষ্ট সভাকক্ষ ও সেমিনার কক্ষ, ১৫০ আসন বিশিষ্ট একটি বড় সেমিনার কক্ষ নির্মাণ হবে। আইসিটি লাইব্রেরিতে থাকবে ৩০টি কম্পিউটার। থাকবে ১টি রেস্ট হাউজ, ২টি ভিআইপি কক্ষ ও সাধারণ ডরমেটরি কক্ষ।

ফখ|চখ

এই বিভাগের আরও খবর