ভারতকে কাঁদিয়ে চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া
দীর্ঘ এক যুগের আক্ষেপ ঘুচাতে পারল না স্বাগতিক ভারত। বিশ্বকাপের পুরো আসরে উড়তে থাকা ভারত ফাইনালে পুরোপুরি নিষ্প্রভ। অন্যদিকে টানা দুই হারে বিশ্বকাপের মিশন শুরু করলেও এরপর অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। সেই অপ্রতিরোধ্য অস্ট্রেলিয়া ভারতের ‘অপরাজেয়’ যাত্রা থামিয়ে রেকর্ড অষ্টমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে রেকর্ড ষষ্ঠ শিরোপা ঘরে তুলল অজিরা।
রোববার (১৯ নভেম্বর) ভারতের আহমেদাবাদে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে টস জিতে স্বাগতিক ভারতকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানায় অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়ার বোলিং তোপে রীতিমতো নাকানিচুবানি খেয়েছে ভারতীয়রা। আহমেদাবাদে প্রায় দেড় লাখ দর্শককে হতাশ করে মাত্র ২৪০ রানে অল-আউট টিম ইন্ডিয়া। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৪৭ রানে তিন উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। এরপর চাপ সামলে ট্রাভিস হেডের সেঞ্চুরি ও মারনাস লাবুশেনের অনবদ্য ব্যাটিংয়ে এশিয়া থেকেই ষষ্ঠ শিরোপা নিজেদেরে করল অস্ট্রেলিয়া।
২৪১ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ইনিংসের প্রথম ওভারের প্রথম বলেই ওয়ার্নারের ক্যাচ যায় স্লিপে। তবে সেখানে স্লিপের ভুলে সেটি বাউন্ডারি হয়ে যায়। সেই ওভারেই আরো দুই বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ১৫ রান তুলে উড়ন্ত সূচনার ইঙ্গিত দেয় দুই অজি ওপেনার ট্রেভিস হেড ও ওয়ার্নার।
তবে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই বিরাট কোহলিকে স্লিপে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেছেন ফর্মের তুঙ্গে থাকা ভারতীয় পেসার মোহাম্মাদ শামি। দলীয় ১৬ রানেই প্রথম উইকেটের পতন। ভরসা ছিল মিচেল মার্শের উপর। দূর্বল ফুটওয়ার্কের মাশুল দিয়েছেন তিনিও। বুমরাহর বলে উইকেটের পেছনে কেএল রাহুলের হাতে আটকা পড়েছিলেন এই অলরাউন্ডার।
ধারাবাহিক আক্রমণে ৯৫ বলেই বিশ্বকাপের ফাইনালে সেঞ্চুরি তুলে নেন অজি এই ওপেনার। অজি এই বাঁহাতি ওপেনারের সেঞ্চুরির ইনিংসের ৩৪তম ওভারে ভারতীয়দের কাঁদিয়ে ষষ্ঠবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ভীত গড়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। শেষদিকে শতকের পূরণের পর আরো মারমুখী হন হেড। ১২০ বলে ১৩৭ রানের দানবীয় ইনিংস খেলে অজিদের শিরোপা নিশ্চিত করে শেষদিকে মাঠ ছাড়েন তিনি।
ওপেনার ট্রাভিস হেডের সেঞ্চুরিতে ৪২ বল হাতে রেখেই ৪৩তম ওভারে ৬ উইকেট হাতে রেখে ম্যাচ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। এই জয়ে বিশ্বকাপের ইতিহাসে ষষ্ঠবারের মতো শিরোপা জিতল অজিরা।
এর আগে টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে আজ ভারতের হয়ে সূচনাটা ভালোই করেছিলেন ওপেনার এবং অধিনায়ক রোহিত। স্ট্রাইকার প্রান্ত থেকে তিনি চড়াও হতে শুরু করেছিলেন অজি বোলারদের উপর। ফলে দ্রুত রান উঠতে শুরু করেছিল ভারতের স্কোরবোর্ডে। তবে রান তলার এ ধারায় বাঁধা পড়ে গিল আউট হলে।
চতুর্থ ওভারে স্টার্কের বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে অ্যাডাম জাম্পার তালুবন্দী হন গিল। ফলে ৭ বলে মাত্র ৪ রান করেই সাজঘরে ফিরতে হয় তাকে। এরপর ক্রিজে রোহিতের সঙ্গী হন বিরাট কোহলি। এ দুজন মিলে দ্রুতই সফল একটি জুটির দিকে এগোচ্ছিলেন। রোহিতের মারকুটে ব্যাটিংয়ে দ্বিতীয় উইকেটে ৩২ বলেই স্কোরবোর্ডে ওঠে ৪৬ রান। তবে এরপরই আবারো আঘাত হানে অস্ট্রেলিয়া।
১০তম ওভারে ম্যাক্সওয়েলের বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ট্রাভিস হেডের ক্যাচে পরিণত হন রোহিত। ব্যক্তিগত অর্ধশতক থেকে ৩ রান দূরে থাকতেই সাজঘরে ফিরতে হয় তাকে। আউট হওয়ার আগে ৩১ বলে ৪ চার আর ৩ ছয়ে করেছেন ৪৭ রান। অধিনায়ক ফেরার ক্রিজে আসেন শ্রেয়াস আইয়্যার।
সেমিফাইনালে সেঞ্চুরি হাঁকানো আইয়্যারও আজ দলের হাল ধরতে পারেননি। পরের ওভারের দ্বিতীয় বলেই তিনিও ফিরে যান কট বিহাইন্ড হয়ে। অজি অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের বলে উইকেটরক্ষক জশ ইংলিশের গ্লাভসবন্দী হয়ে ৪ রান করেই প্যাভিলিয়নের পথ ধরতে হয় তাকে।
এরপর চতুর্থ উইকেটে ব্যাট করতে নামা লোকেশ রাহুলকে নিয়ে শুরুর ধাক্কা সামল দিয়ে এগোতে থাকেন কোহলি। ইনিংসের ২৬তম ওভারে নিজের অর্ধশতক পূরণ করে বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখতে থাকেন বিরাট। তবে অজি অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের বলে ব্যক্তিগত ৫৪ রান করে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফিরেন কোহলি।
মিডল অর্ডার ব্যর্থতার দিনে ব্যাটিংয়ে প্রমোশন দেওয়া হয় রবীন্দ্র জাদেজাকে। তবে টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি জাদেজা। দেখে-শুনে খেলেও বেশিক্ষণ উইকেটে থাকতে পারেননি। ৩৬তম ওভারের পঞ্চম বলে হ্যাজলউডের খাটো লেন্থের ডেলিভারিতে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়েছেন তিনি। সাজঘরে ফেরার আগে তার ব্যাট থেকে এসেছে ২২ বলে ৯ রান।
এদিকে উইকেটে লম্বা সময় কাটালেও মন্থর ব্যাটিংয়ে ইনিংস বেশি লম্বা করতে পারেনি লোকেশ রাহুল। মিচেল স্টার্কের বলে কট বিহাইন্ড হয়ে তিনি ফিরলেন ১০৭ বলে ৬৬ রান করে। যা অজিদের বিপক্ষে ভারতীয় ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটার তিনি। রাহুলের বিদায়ে পর আড়াইশর আগেই থেমে যাওয়ার শঙ্কায় ভারতের দলীয় ইনিংস। হলও তাই।
রাহুলের ফিরে যাওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে সাজঘরে ফিরেন মোহাম্মদ শামি ও জাস্প্রিত বুমরাহ। দলীয় ২১৪ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে দ্রুত অলআউট হওয়ার শঙ্কায় পড়ে স্বাগতিকরা। সূর্যকুমার যাদব ও কুলদীপ যাদব মিলে শেষ দিকে আশা জাগানোর মতো কিছুই করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ২৪০ রানে অলআউট হয়ে যায় ভারত। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট নেন পেসার মিচেল স্টার্ক।
বিশ্বকাপ ফাইনালে রেকর্ড শতক হাঁকিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছেন অজি ওপেনার ট্রাভিস হেড।
উল্লেখ্য, দুই যুগ আগের আসরেও শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে দেখা হয়েছিল ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার। সেবার ভারতকে হারিয়ে ট্রফি ঘরে তুলেছিল অস্ট্রেলিয়া। আরও একবার সেই হতাশা নেমে আসলো আহমেদাবাদে। এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ২০ বছর আগের ফাইনালে ভারতকে ১২৫ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। রিকি পন্টিংয়ের ১৪০ রানের অপরাজিত ইনিংসে আগে ব্যাটিং করে ২ উইকেটে ৩৫৯ রান করেছিল অজিরা। রান তাড়ায় তেমন লড়াই করতে পারেনি ভারত। ভিরেন্দ্র শেবাগ ছাড়া ফিফটি করতে পারেননি দলটির কেউ। তাতে ২৩৪ রানেই গুটিয়ে যায় ভারত।
চখ/ফখ