chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

স্বপ্নের টানেলের দ্বার খুলছে ২৮ অক্টোবর

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল বাংলাদেশের সমৃদ্ধির চিহ্ন।চট্টগ্রামবাসীর অনেক দিন অপেক্ষায় ছিল কবে উদ্বোধন হবে স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেল।এবার অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলছে। ঠিক হয়েছে উদ্বোধনের দিনক্ষণ।

আগামী ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে। উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সোমবার (১৪ আগস্ট) রাজধানীর বনানীতে সেতু ভবনে সংবাদ সম্মেলনে এসব জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে আগামী ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তা ছাড়া আগামী ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট অংশে উদ্বোধন করা হবে।’

তিনি জানান, আগামী অক্টোবরে সরকারের ১৫০টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু টানেল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যোগ করবে নতুন মাত্রা।দক্ষিণ চট্টগ্রাম সরাসরি শিল্পায়নে যুক্ত হবে।আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে। চট্টগ্রামে উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে আরেক মেগা প্রকল্প এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।কর্ণফুলী নদীর এই টানেল ও শহরের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে।

টানেলর কারণে মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আবার টানেল ব্যবহার করে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ সারা দেশের কারখানার পণ্য কক্সবাজারের মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরে আনা-নেওয়া করা যাবে দ্রুত সময়ে।

চট্টগ্রাম শহর এড়িয়ে যোগাযোগ–সুবিধার কারণে শিল্পকারখানার কাঁচামাল যেমন সহজে আনা-নেওয়া করা যাবে, তেমনি প্রস্তুত–পণ্যও সারা দেশে খুব সহজে নেওয়া যাবে টানেলের মাধ্যমে। টানেলের কারণে শুধু অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিস্তৃতে হবে না, একই সঙ্গে পর্যটনশিল্পেরও বিকাশ ঘটবে।

কর্ণফুলী নদীর ওপারে কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইপিজেড, সিইপিজেড, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। বাড়বে দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ। সাশ্রয় হবে অর্থ ও সময়ের।সর্বোপরি পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও শিল্পায়নের অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে টানেল। দুই পাড়ের জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন হবে।

চট্টগ্রাম হবে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’

টানেল উদ্বোধন হলে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম পরিণত হবে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের সঙ্গে সহজ যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনের ফলে পূর্ব প্রান্তে পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে।

চীনের সবচেয়ে বড় ও জনবহুল নগরী সাংহাই পরিচিত ওয়ান সিটি টু টাউন হিসেবে। দেশটির এই শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্রকে দুই ভাগে ভাগ করেছে চ্যাং জিয়াং নদীর উপনদী হুয়াংপু, যে নদীতে নির্মিত টানেল যুক্ত করেছে দুই পাড়কে। সাংহাই সমুদ্রবন্দর বর্তমান বিশ্বের ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দর, সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দরগুলোর একটিও। আর সাংহাইয়ের মতো ভৌগোলিক অবস্থা বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এবং কর্ণফুলী নদীর ওপারের আনোয়ারা উপজেলার।

বঙ্গবন্ধু টানেল র্শীষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সমীক্ষা শুরু হয় ২০১২ সালে।সেতু কর্তৃপক্ষ, চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল) ও অভি অরূপ অ্যান্ড পার্টনার্স হংকং লিমিটেড যৌথভাবে টানেল নির্মাণের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা করে।

২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে দুই দেশের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে (সরকারের সঙ্গে সরকারের) সমঝোতা স্মারক সই হয়।

চীন সরকারই সিসিসিসিএলকে এই টানেল নির্মাণের জন্য মনোনীত করে। এ বিষয়ে ওই বছরের ৩০ জুন সেতু কর্তৃপক্ষ ও সিসিসিসিএলের মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি হয়।

পরে ২০১৫ সালের নভেম্বরে একনেক সভায় ‘কনস্ট্রাকশন অব মাল্টি লেন রোড টানেল আন্ডার দ্য রিভার কর্ণফুলী’শীর্ষক টানেল প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়।

প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২০ সালের জুন এবং ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। পরে প্রকল্পের মেয়াদ আড়াই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। আর ১ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।

প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার অর্থসহায়তা দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। প্রকল্প সাহায্যের বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। এই টাকা ঋণ হিসেবে পরিশোধ করতে হবে। ঋণের সুদের হার ২ শতাংশ।

সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের শেষ প্রান্ত মিলিত হয়েছে টানেলের মুখে। একই সঙ্গে টানেল যুক্ত হয়েছে পতেঙ্গা আউটার রিং রোড সড়কের সঙ্গে।কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ প্রান্তে মূল সড়কটি যুক্ত হয়েছে পিএবি (পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী) সড়কে।

দুই প্রান্তে সংযোগ সড়কগুলোর কাজ শেষ। নগর প্রান্তের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ছয় লেনের টানেল সংযোগ সড়কটি।

বদলে যাওয়া এক “জনপদ” চট্টগ্রাম

গত এক দশকে চট্টগ্রামের যোগাযোগ অবকাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাল্টে যায় চট্টগ্রামের যোগাযোগ অবকাঠামোর চিত্র। নগরীর ভেতরে এবং নগরীর সাথে উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগ চিত্র পাল্টে দিয়েছে এসব অবকাঠামো।

২০১০ সালে ‘মান্নান ফ্লাইওভার’ র্নিমাণের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় সরকারের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ।নগরীর এককিলোমিটার থেকে শুলকবহর  পর্যন্ত দীর্ঘ ১ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

এরপরে একে একে বটতলী স্টেশন থেকে ডিটি রোডের ধনিয়ালাপাড়া পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার, মুরাদপুর থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত চার লেনের আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ফ্লাইওভারের নির্মাণ করা হয়।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজপতেঙ্গা থেকে সাগরিকা পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধের ওপর ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ আউটার রিং রোড নির্মাণ করা হয়। ২ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেইনের ৮৪ ফুট চওড়া সড়কটি।যা যুক্ত হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেলের সাথে।

সড়ক অবকাঠামোর পাশাপাশি বন্দর নগরীর অন্যতম প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা নিরসনে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তিন সংস্থা।৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনের মেগা প্রকল্পটিও বাস্তবায়ন করছেন সিডিএ।ইতিমধ্যে ৭৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কাজ শেষ।

১ হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে নগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ইতিমধ্যে ৩০ শতাংশ কাজ শেষ।

১ হাজার ৩৭৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বহদ্দারহাটের বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সিটি করপোরেশন।

স্বপ্নের রেল : উদ্বোধনের অপেক্ষায় চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেলপথ

এবার উদ্বোধনের অপেক্ষায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার স্বপ্নের রেলপথ। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদসৈকতের নগরী কক্সবাজার সাথে সারা দেশের সাথে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে।চলমান প্রকল্পে ইতিমধ্যে ৯৪ শতাংশ কাজ হয়েছে।

সংগৃহীত

সেপ্টেম্বরে উদ্বোধনের কথা থাকলেও সাম্প্রতিক বন্যা পিছিয়ে যেতে পারে উদ্বোধন।তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছে নির্ধারিত সময়ে ট্রেন যাবে কক্সবাজার।

রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, এক কিলোমিটারজুড়ে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ করা যাবে। তাই নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চালু নিয়ে সমস্যা হবে না।

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড দুই ভাগে কাজটি করছে।

দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইনের মধ্যে ৩৯টি বড় সেতু, ২২৩টি ছোট সেতু ও কালভার্ট, বিভিন্ন ধরনের ৯৬টি লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করা হচ্ছে। হাতি চলাচলের জন্য রাখা হয়েছে আন্ডারপাস। ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজারে।

কক্সবাজারের ঝিলংঝার চান্দেরপাড়া এলাকায় ঝিনুকের আকৃতিতে গড়ে তোলা হচ্ছে দেশের প্রথম আইকনিক রেলস্টেশন। পাশাপাশি দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মোট ৯টি স্টেশন নির্মান করা হয়েছে। এছাড়া সংরক্ষিত বন এলাকায় রেললাইন স্থাপনে বন্যহাতি ও বন্যপ্রাণি চলাচলের জন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে।

চখ/এআর

এই বিভাগের আরও খবর