পোশাক রফতানির খাত নেতিবাচক ধারায় ফেরার শঙ্কা
পোশাক রফতানিতে গত দুই মাসে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হলেও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে চলতি মাস থেকে রফতানিতে নেতিবাচক ধারায় ফিরতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিল্প মালিকরা। তারা বলছে, গত চার মাস ধরে পোশাকের ক্রয়াদেশ কমছে, আর এটাই শঙ্কার মূল কারণ। গতবছর জুনে ক্রয়াদেশ থাকলেও গ্যাস সঙ্কটের কারণে পোশাক উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।
এরপর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে পোশাকের রফতানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে কমে যায়। এজন্য তৈরি পোশাক শিল্পে উৎপাদন কার্যক্রমের স্বার্থে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ ও ক্রমান্বয়ে মূল্য বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী এবং বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বরাবর
চিঠি দিয়েছে সংগঠনটি।
এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বলেছেন, পোশাক শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এবং এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত জনবলকে উৎসাহ দিতে তৈরি পোশাকের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
চিঠিতে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক
হাসান বলেছেন, তৈরি পোশাক শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তৈরি পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে দেশেরনমোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশ অর্জিত হচ্ছে।
দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া টেরিটাওয়েল, বস্ত্রশিল্পসহ অন্যান্য খাতে অর্জিত হয় প্রায় ৮৮ শতাংশ। সরকারের
আন্তরিক সহযোগিতায় করোনাকালীন সংকট মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শিল্প। এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট চলছে। শিল্পে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন পরিচালনায় জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বর্তমানে অনিয়মিত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের কারণে কারখানায় উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে ১২ জানুয়ারি গ্যাসের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। কিছুদিন আগে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য বাড়ানো হয়েছে। এ অস্বাভাবিক মূল্য বাড়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে ইতোমধ্যে কাঁচামালের মূল্য বেড়েছে। পোশাক শিল্পে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। মূল্যস্ফীতিও বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক ঋণের সুদহারও বেড়েছে, আগামীতে আরো বাড়বে। এতে শিল্পকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক
সংকটের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম অত্যধিক বৃদ্ধিতে শ্রমিকরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে। এ কারণে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষও তৈরি হবে। সামগ্রিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্য না বাড়িয়ে সিস্টেম লস,মিটার রিডিং, অবৈধ সংযোগ ইত্যাদি বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে বন্ধ করার অনুরোধ জানান বিজিএমইএ সভাপতি।
তিনি বলেন, এতে সিস্টেম লস শূন্যের কোটায় আসবে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক সংকট লাঘবে আগামী এক বছরের জন্য
আমদানিকৃত জ্বালানি পণ্যে কাস্টমস শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান তিনি।
পোশাকশিল্পের মালিকরা জানান, গত দেড় বছরে সুতার দাম বেড়েছে ৬২ শতাংশ, কনটেইনার ভাড়া বেড়েছে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ, ডাইসসহ রাসায়নিকের খরচ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। গত বছরের শুরুতে মজুরিও বেড়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে গত ৫ বছরে পোশাকশিল্পে উৎপাদন ব্যয়
বেড়েছে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। এত খরচ বাড়ার পরেও ক্রেতারা এক টাকাও পণ্যমূল্য বাড়ায়নি। এর পর নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোয় উৎপাদন খরচ
বাড়বে ৩৭ শতাংশ। নতুন করে এই খরচ বহন করা পোশাকশিল্প মালিকদের জন্যনকঠিন হবে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে ৩৯০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম। আর অক্টোবরে ৩৫০ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ, যা ২০২১ সালের অক্টোবরের চেয়ে ৭
দশমিক ৮৫ শতাংশ কম। তবে রপ্তানিকারকদের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করেন নভেম্বর মাসে ৫০৯ কোটি ২৫ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়, যা আগের বছরেরনএকই মাসের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। এরপর ডিসেম্বর মাসে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়, রফতানি হয় ৫৩৬ কোটি ৫১ লাখ ডলারের পণ্য। টাকা বা ডলারের হিসাবে ডিসেম্বর মাসে যে পরিমাণ রফতানি আয় হয়েছে, তা
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাসের সর্বোচ্চ।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিশ্বখ্যাত তৈরি পোশাক ব্র্যান্ড প্রাইমার্ক অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট-এর একটি প্রতিনিধি দলের সাথে গত বুধবার মতবিনিময় করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
এসময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, গত বছর ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক বাংলাদেশ রফতানি করেছে, ২০৩০ সালে এ রফতানির পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে কাজ করছি। বাংলাদেশ এখন চাহিদা মোতাবেক যে কোনো পরিমাণ পণ্য যথা সময়ে সরবরাহ করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। আমরা রফতানি বাণিজ্যে বড় লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।’
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘প্রাইমার্ক আমাদের বড় ক্রেতা, বিশ্বখ্যাত এ পোশাক ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকেসআরো বেশি তৈরি পোশাক ক্রয় করবে বলে বিশ্বাস করি, একই সাথে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে, এ শিল্পের সাথে জড়িত জনবলকে উৎসাহ দিতে তৈরি পোশাকের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের উন্নয়নে সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করছে। তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, পণ্যের মান ও ডিজাইন আধুনিক করা হচ্ছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বিশ্বমানের ও আধুনিক তৈরি পোশাক তুলনামূলক কম দামে সরবরাহ করতে সক্ষম।
নচ/চখ