chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

ইতিহাস-ঐতিহ্যে চট্টগ্রামের তিন মসজিদ

সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের প্রাচীন সব স্থাপত্য নিদর্শন। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে সুলতানি ও মোগল আমলের নির্মাণ শৈলী। চট্টগ্রামে পুরাতাত্ত্বিক কিছু স্মৃতিচিহ্ন আছে মসজিদকে ঘিরে।

২০০ থেকে ৮০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যের এসব স্মারকও হারিয়ে যাওয়ার পথে। চট্টলার খবরের এবারের আয়োজন প্রত্মতাত্বিক মসজিদ। ঐতিহাস-ঐতিহ্যগুলো পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন বিশেষ প্রতিনিধি সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ।

৩৫৪ বছরে পা রাখলো আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ

ইতিহাস আর ঐতিহ্যের এক অন্যতম স্থাপত্য আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। প্রায় তিনশ ৫৪ বছর আগে চট্টগ্রাম সদরে নির্মিত এই এ মসজিদটি ঘিরে রয়েছে অসংখ্য ইতিহাস ও মোগল সাম্রাজ্যের অনন্য নিদর্শন। এ কেল্লায় এক সময় মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল বলে কথিত আছে। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের তৎকালীন মোগল শাসনকর্তা শায়েস্তা খাঁর ছেলে উমেদ খাঁ এ কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করলে তখন থেকে এর নাম হয় ‘আন্দরকিল্লা’

 

যুদ্ধ বিজয়ের স্মারক হিসেবে দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেব চট্টগ্রামের নতুন নামকরণ করেন ইসলামাবাদ। তারই নির্দেশে চট্টগ্রাম বিজয়ের মোগল স্মারক চিহ্ন হিসেবে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ সালে ‘আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ’ নির্মাণ করেন। দিল্লি’র এক ঐতিহাসিক জামে মসজিদের অবয়বে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।

সমতল ভূমি থেকে প্রায় ত্রিশ ফুট ওপরে ছোট্ট পাহাড়ের ওপর মসজিদটির অবস্থান। মূল মসজিদের নকশা অনুযায়ী, আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ ১৮ গজ (১৬ মিটার) দীর্ঘ, ৭ দশমিক ৫ গজ প্রস্থ। প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২ দশমিক ৫ গজ পুরু। পশ্চিমের দেয়াল পোড়া মাটি এবং বাকি তিনটি দেয়াল পাথর দিয়ে তৈরি। মধ্যস্থলে একটি বড় এবং দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা ছাদ আবৃত। ১৬৬৬ সালে নির্মিত মসজিদের চারটি অষ্টভুজাকৃতির গম্বুজগুলোর মধ্যে পেছন দিকের দুটি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। মসজিদটির পূর্বে তিনটি, উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে মোট ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদটিতে তিনটি মেহরাব থাকলেও সাধারণত মাঝের সর্ববৃহৎ মেহরাবটিই বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে।

মসজিদটির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মসজিদে প্রতিদিন অন্তত ৪ হাজার মুসল্লি নিয়মিত নামাজ আদায় করতে পারার ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। মসজিদে প্রতি শুক্রবার একত্রে গড়ে ৮ থেকে ৯ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করেন। পবিত্র রমজান মাসের জুমআতুল বিদায় ২০ থেকে ২৩ হাজার মানুষের বিশাল জামাত অনুষ্ঠিত হওয়ার নজিরও রয়েছে।

 

শায়েস্তা খাঁর স্মৃতিবাহী তাজ মসজিদ :

স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত চট্টগ্রামের প্রাচীন চন্দনপুরা মসজিদ (তাজ মসজিদ)। ২৫১ বছরের পুরনো মসজিদটি নগরীর চকবাজার ওয়ার্ডের সিরাজ-উদ-দৌলা সড়কে এটি অবস্থিত। মোগল স্থাপনা শিল্পের আদলে ১৮৭০ সালে মাটি ও চুন সুরকির দেয়াল আর টিনের ছাদের মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন আব্দুল হামিদ মাস্টার। তখনও মাটির দেয়ালে কারুকাজে ভরপুর ছিল। তার বংশধর ব্রিটিশ সরকারের ঠিকাদার আবু সৈয়দ দোভাষ ১৯৪৬ সালে এই মসজিদের সংস্কার কাজে হাত দেন। মসজিদের কারিগর ও নির্মাণ সামগ্রী ভারত থেকে আনা হয়। এতে সেই সময়ে প্রায় পাঁচ লাখ টাকারও অধিক খরচ হয়। চারপাশের দেয়ালগুলো ভেন্টিলেশন সিস্টেমের। দেয়ালের ফাঁক গলে ঢুকছে আলো। হরেক রঙ ব্যবহার করা হয়েছে স্থাপনার প্রতিটি অংশে। লতা-পাতার নকশা আর নানান কারুকাজে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সুনিপুণ হাতে। অনেক দূর থেকে দেখা যায় মসজিদটির বাহ্যিক সৌন্দর্য। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি অসংখ্য দর্শনার্থী আসে তাজ মসজিদ দেখতে।

মোগল আমলে নির্মিত তাজ মসজিদের রয়েছে ১৫টি গম্বুজ। এর মধ্যে বড় গম্বুজটি নির্মাণে তৎকালীন সময়ের প্রায় চার লাখ টাকার ১৫ মণ রুপা ও পিতলের প্রয়োজন হয়, যা সংগ্রহ করা হয় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। গম্বুজের চারপাশে লেখা আছে রাসুল (সা.)-এর পরিবার ও দুনিয়ায় জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ সাহাবির নাম। মসজিদটির সুউচ্চ মিনার থেকে শুরু করে দেয়াল, উঁচু পিলার, দরজা-জানালা সব কিছুতেই রয়েছে নান্দনিক কারুকাজ। এ ছাড়া মসজিদটিতে রয়েছে দুর্লভ ইসলামী নিদর্শনাবলির সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা।

 

৮০০ বছরের পুরানো সাহেব বিবি মসজিদ :

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত প্রায় ৮০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সাহেব বিবি মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল মোগল আমলে। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, জমিদার আমির মোহাম্মদ চৌধুরীর পত্নী ও চট্টগ্রামের আলোচিত সুপ্রসিদ্ধ মালকা বানুর মাতা সাহেব বিবি এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা যার কারণে তার নামেই এই মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছিল।

৩০ শতক জমির ওপর চুন সুরকির গাঁথুনিতে নির্মাণ করা হয়েছিল দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাটি। ঐতিহ্যবাহী সাহেব বিবি জামে মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে ৮টি পিলার, ৩টি দরজা, ২টি জানালা ও সুউচ্চ ১টি গম্বুজের ওপর। মসজিদের পশ্চিম পাশেই রয়েছে সুদীর্ঘ ১টি মিনার। প্রশস্ত জায়গার ওপর নির্মিত মসজিদের সামনে রয়েছে পবিত্র কাবা শরিফের আদলে তৈরি করা আকর্ষণীয় একটি প্রবেশদ্বার। মসজিদের পাশেই রয়েছে ফুলের বাগান সংবলিত কবরস্থান। সেই কবরস্থানেই ঐতিহ্যবাহী সাহেব বিবি জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মরহুমা সাহেব বিবি’কে সমাধিস্থ করা হয়। এর সামনে নির্মাণ করা হয়েছে ঈদগাহ। ডান পাশে রয়েছে বিশালাকার এক শাহী পুকুর। এটি ‘সাহেব বিবির দিঘি’ হিসেবে এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত। তৎকালে ঐতিহাসিক সাহেব বিবি মসজিদসহ বাদশা মুহাম্মদ শাহ এস্টেটের আমলে ডিমের আটা, চুন-সুরকি দিয়ে দেশের ২২টি গ্রামে একই রকম আরও মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই ২২টি মসজিদের মধ্যে সর্বপ্রথম সাহেব বিবি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ঐতিহাসিক সাহেব বিবি মসজিদ চট্টগ্রাম বিভাগের সবচেয়ে সুপ্রাচীন মসজিদ হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর