চট্টগ্রামে ভবঘুরেদের কুয়াশার চাদরেই কাটে কষ্টের রাত
রাত এগারোটা। কোতোয়ালী থানার মোড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ব্যানার মুড়িয়ে ঘুমিয়ে আছেন চারজন। ব্যানার পুরো শরীর ঢাকতে পারেনি। পা বেরিয়ে আছে। ওখানে তখন ঠান্ডাও বেশ। কথোপকথনের আওয়াজ শুনে চোখ মেলে তাকান রফিক নামের এক ব্যক্তি। নির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও আনুমানিক ৩০ বছর বয়সী। এ যুবকের বাড়ি নোয়াখালী। সারাদিন ভিক্ষা করে সে এবং তাঁর সঙ্গীরা। সারাদিন শেষে আয় হয় দুইশ’ তিন’শ টাকা। এর মধ্যে প্রায় পুরাটাই ব্যয় হয় খাওয়ার পেছনে। তিন বেলার খাবার ছাড়াও পান বিড়ির বদ অভ্যাস আছে বলে জানায় সে। শীত লাগে না? জানতে চাইলে বলেন, লাগলে কি করুম। বাড়ি থেইক্যা কিছু আনি নাই। আবার সব জায়গাও চিনি না।
কথার এক পর্যায়ে তিনি জানান, প্রায় এক মাস ধরে এখানে রাত কাটান। শীতে কোনখানে যাওয়ার পথ নেই তাঁর। তাঁর পাশে শুয়ে থাকা আল আমিন সরকার (৫৫)। তাঁর মুখে দুঃচিন্তার ছাপ। মশা তাড়ানোর জন্যে শরীরের বিভিন্ন অংশে থাপ্পর দিতে দিতে বলল, ‘মশার খুব কষ্ট ভাই’। এভাবে ঘুম আসে? জানতে চাইলে বলেন, ‘মেলা খাটনির পর আর জাইগ্যা থাকন যায় না। যখন ঘুম আসে না, তখন পরিবারের কথা ভাবি শুইয়্যা শুইয়্যা।
ঠান্ডায় গান বন্ধ হয়ে গিয়েছে শিবলী পাগলা ও কাশেমের। চট্টগ্রাম জেল রোডের ফুটপাতের এক পাশে বসে গত ১৫ দিন আগেও গলা ছাড়িয়ে গান করতো তাঁরা। ইদানিং রাস্তায় দেখামিলছে না তাদের অনেকের। ঠান্ডা যত নামছে ততই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন ভবঘুরেরা। ট্রেনের কামরা থেকে বাসস্ট্যান্ড, রাস্তার ফুটপাত, ওভারব্রীজের নীচে ঠান্ডায় জড়োসড়ো হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তারা।
কয়েকদিন ধরে শৈত্যপ্রবাহ ছক্কা হাঁকিয়ে ঠান্ডা নামিয়ে কনকনে শীত এনেছে চট্টগ্রামে । আজ রোববার সকাল ৮ টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রিতেও নেমে গিয়েছিল। সঙ্গে কুয়াশা ঘন মেঘলা আবহাওয়ায় ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকায় কাঁপুনি বাড়তে থাকে। প্রচন্ড শীতে নগরের ভবঘুরেদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের করিডোরে আস্তানা অন্তত ২০/২৫ জন ভবঘুরের। বর্ষা এবং ঠান্ডার সময়টাই তাদের সমস্যা। সব চেয়ে বেশি কষ্ট ঠান্ডায়। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর কয়েকটি শীতবস্ত্র, কম্বল দিয়ে থাকে। সেটাই ভরসা।
কাশেম, সাহেদ, রফিক, রহিমা, পান্নাসহ কয়েকজন জানান, ঠান্ডার সময়টা খুবই সমস্যা। কনকনে বাতাসে ফাঁকা করিডোরে বসা যায় না। তখন ওয়ার্ডের কাছাকাছি একটা নিরাপদ জায়গা বেছে নিতে হয়।
চেরাগি পাহাড়ের গলির রাস্তায় ঠান্ডার মধ্যে দিনভর বসে রয়েছেন বৃদ্ধ এক মহিলা। কয়েকদিন আগেও শীতের পোশাক একেবারেই ছিল না। সম্প্রতি তাঁকে একটি কম্বল দিয়ে গিয়েছেন সহৃদয় কোনও ব্যক্তি। তা মুড়িয়েই ভিক্ষা করতে বসে রয়েছেন রাস্তার একধারে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা, সাড়ে সাতটা পর্যন্ত গলি রাস্তাতেই বসে ভিক্ষা করেন । তারপর তাঁর রাত কাটে জামালখান মোড়ের খোলা আকাশের নিচে। তিনি বলেন, রাতে হিম শীতল ঠান্ডায় শরীর অবশ হয়ে যায়। শীতের রাতে সবচেয়ে বেশি ভবঘুরের ঠাঁই হয় চট্টগ্রাম রেলস্টেশন, ষোলশহর রেলস্টেশন ও ওভারব্রীজগুলোর নিচে।
শুক্রবার রাতে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, একদল ভবঘুরে শিশু শুকনো পাতা, প্লাস্টিক হাতের কাছে যা পায় তা পুড়িয়ে ওম নেওয়ার চেষ্টা করছে। কথা হয় সেলিম, নেওয়াজ, লাকি, তমাল, সাহেদ, রুবেল ও ফাতেমার সাথে। রাতে তারা কেউ দোকানের বারান্দায় আবার কেউ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে থাকেন। তারা জানান, রাতে কুয়াশার চাদরে কাটে তাদের রাত।
বহদ্দারহাট মোড় থেকে বাঁ দিকে রাস্তা চলে গিয়েছে চকবাজারের দিকে। সেই রাস্তার পাশে জঙ্গী শাহ মাজারের সামনে বসে রিনা । বাসিন্দারা জানালেন, গত কয়েকদিন ধরে গান গেয়ে ভিক্ষে করছে না রিনা। বাসিন্দারা জানেন তাঁর নাম রিনা বৈরাগী। চোখে মুখে বলিরেখা দেখে বোঝা যায় বয়স ষাটের কোঠায়।কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলেন না। দিনভর রাস্তায় ঘুরে গান গেয়ে ভিক্ষে করেন। কনকনে ঠান্ডায় আপাতত রিনার গান বন্ধ। এলাকার এক মিষ্টির দোকানের মালিক একটি কম্বল দিয়েছেন তাঁকে। সেই কম্বল গায়ে জড়িয়েই রাস্তার পাশে বসে থাকেন।
জিইসি মোড় এলাকায় এক মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা দোকানের বারান্দায় থাকেন। রাতে পাতলা কম্বল মুড়িয়ে বেহুশের মতো পড়ে থাকতে দেখা যায় গত সোমবার রাতে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফোরামের মহাসচিব আকতার উদ্দিন রানা চট্টলার খবরকে বলেন, আশ্রয়হীন ভবঘুরে, মানসিক ভারসাম্যহীন, দিনমজুর, রিকশা ও ভ্যানচালকদের কম্বল ও শীতবস্ত্র দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি। সবার এগিয়ে আসা দরকার।
চট্টগ্রাম নগরে ভবঘুরেদের নিয়ে চিন্তা করেন এমন দুইজন হলেন প্রত্মত্বত্তবিদ ও ইতিহাস গবেষক সোহেল মোহাম্মদ ফখরুদ্দীন ও ইসলামি ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় নেতা রেজাউল করিম তালুকদার চট্টলার খবরকে বলেন, ফুটপাত থেকে বারান্দা সম্বল বলতে একটা কাপড়ের পুঁটলি৷ যার ভিতরে নোংরা জামা-কাপড়ের পাশাপাশি রয়েছে পুরনো অথবা ছেঁড়া একটা কম্বল বা কাঁথা৷ কনকনে ঠান্ডায় একমাত্র সেটাই ভরসা চট্টগ্রামের বেশিরভাগ ভবঘুরের ৷ গরমের রাতে শহরের বিভিন্ন রাস্তার পাশে তাদের ঠাই নিতে দেখা যায় এই ভবঘুরেদের৷ কিন্তু ঠান্ডায় বেকায়দায় পড়া সেই ভবঘুরেদের অনেকেই ঠাঁই নিয়েছেন রেল স্টেশনে বা বাস স্ট্যান্ডের কোন সেডের নীচে, তো কেউ বা হাসপাতালের প্রতীক্ষালয়ের এক কোণে৷ সেখান থেকে অনেক সময় দারোয়ান বা মানুষের তাড়াও খেতে হচ্ছে তাদের৷ তখন আবার তাদের ঠাঁই হচ্ছে কোন বন্ধ দোকানের সাটারের নীচে৷ তাঁদের সহযোগিতায় রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকা দরকার।
নচ/চখ