chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

লালঘর ও লালকুঠির লালে ‘লালদীঘি’

ঐতিহ্য

১৭৬১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রামে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর এন্তেকালী কাছারি অর্থাৎ জমি সংক্রান্ত তহসিল অফিসে (বর্তমানে মেট্রোপলিটন পুলিশ অফিস) লাল রঙ দেয়া হয়েছিল। লোকজন তাই এটিকে ‘লালকুঠি’ বলে চিনত। এই লাল কুঠির পূব দিকে ছিল জেলখানা। এটিকেও লাল রঙ করায় তৎকালীন সময় এটি ‘লালঘর’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই ভবন দুটি লাল পাগড়ি পরিহিত ব্রিটিশ পাহারাদারেরা পাহারা দিত। অনেকেই মনে করেন এ কারণেই ভবনগুলোর নাম লাল ঘর এবং লাল কুঠি। লাল ঘর এবং লাল কুঠির কাছে ছিল দীঘি। পাশেই দুটি লাল রঙের ভবন ছিল বলেই এই দীঘিটা লালদীঘি নামে পরিচিত হয়।

লাল দীঘির ঘটনা নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষের মুখে একটা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। একবার এক দিনমজুরের মেয়ে ঐ দীঘিতে গোসল করতে নেমেছিল। হঠাৎ পায়ে শিকল বেঁধে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো দীঘির পদদেশের এক অদ্ভূত দেশে। আসলে তা ছিল এক বাদশার দরবার। সেই বাদশার বিয়ে ঠিক হয়েছিল লাল বেগমের সাথে। একদিন বাদশা লাল বেগমকে দেখতে চাইলেন কিন্তু খবর পাওয়া গেল লাল বেগম তার মুলক থেকে পালিয়ে গেছেন। এ খবর বাদশা তখন জানতেন না। তাই মজুরের ঐ মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছে বাদশার সাথে লাল বেগমের অভিনয় করার জন্য। অনেক কথা প্রসঙ্গে বাদশা মেয়েটার আসল পরিচয় জেনে যান। ক্ষুদ্ধ বাদশার নির্দেশে সবাই আসল লাল বেগমকে খুঁজতে লেগে গেল। তখন জানা গেল সে আন্দরকিল্লার দীঘি থেকে দু’শ হাত দূরে পর্তুগিজদের কিল্লায় আছেন। বাদশা ঐ কিল্লায় আক্রমণ করেন। অনেক অনেক খুনে লাল হয়ে গেল দিঘির পানি। তবুও লাল বেগমকে উদ্ধার করার আশা নিয়ে ওই দীঘির পাড়ে বাদশা থেকে গেলেন।
চট্টগ্রাম নগরীর ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে লালদীঘি হলো অন্যতম একটি স্থান। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত জেল রোডের শেষ প্রান্তে অবস্থিত লালদীঘির আশেপাশে রয়েছে আন্দরকিল্লা, জেলা পরিষদ ভবন, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ডিবি ও এসবি কার্যালয়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রিয় জেলখানা, চট্টগ্রাম আদালত ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। দীঘির পাড়ে রয়েছে দৃষ্টি নন্দন লালদীঘি মসজিদ। শহরবাসীর চিত্তবিনোদনের জন্য এখানে একটি সবুজ গাছপালা ঘেরা পার্ক আছে। রয়েছে চসিকের আধুনিক পাবলিক লাইব্রেরি। লালদিঘির উত্তর পাশে রয়েছে একটা মঠ যার গম্বুজে লেখা আছে ১৯৩৯ সাল। এটার গায়ে লেখা আছে রায় বাহাদুর রাজকমল ঘোষের নাম। রায় বাহাদুর ছিলেন জমিদার। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তার নিজ বাড়ি ছিল রাউজান উপজেলার চিকদাইর গ্রামে। তিনি অবসর সময় কাটাতেন তখনকার খোলামেলা লালদিঘির পাড়ে। তিনি ছিলেন লালদিঘির অভিভাবক। পরে দীঘিটির মালিকানা তিনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের হাতে তুলে দেন।
লালদীঘির পশ্চিম পাড়ে ছিলো “রিকেট ঘাট”। ১৯৪১ হতে ১৯৪৮ পর্যন্ত চট্টগ্রামের কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করা স্যার হেনরী রিকেটস এর স্মরণে চট্টগ্রামের জমিদারেরা এই ঘাট নির্মাণ করেছিলেন। হার্ভে ১৮৩১-১৮৩৯ সালে চট্টগ্রামের কালেক্টর ছিলেন।
ঊনিশ শতকের শেষে মিউনিসিপাল ময়দান দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পূর্বদিক সাধারণ জনগণের খেলার মাঠে রূপান্তরিত হয়। মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তখন ওই মাঠ মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে পরিণত হয়। এই মাঠ এখন লালদিঘির মাঠ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
লালদীঘির পাড়ে ১৯১০ সালে বৈশাখের ১২ তারিখ আবদুল জব্বার সর্বপ্রথম বলীখেলা অনুষ্ঠান করেন। তখন থেকে প্রতি বছর বৈশাখের ১২ তারিখ লালদিঘির পাড়ে জব্বারের বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

এই বিভাগের আরও খবর