বান্দরবানের রাজা-রাজ্যের অন্দরমহলে
১৯৩৪ সাল । বোমাং রাজা ক্য জাসাইনের হাত ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠল বান্দরবানের প্রধান আকর্ষণ রাজবাড়ি। আগাগোড়া যার মিয়ানমারের স্থাপত্য সুচিন্তিত পরিকল্পনার পরিচয় বহন করে। সৈন্য প্রবেশের প্রধান পথ ছিল অমর সিংহ গেইট। বিশাল আকার দুটি সিংহ প্রবেশ পথে আপনাকে স্যালুট করবে। রাজবাড়ির বাগিচা জুড়ে ফুটে থাকে নানান রঙ্গিন ফুল। পূর্ণিমার রাতে শ্বেতপাথরের গড়া এ বাড়িটি বড় বেশি রমনীয়,স্বপ্ন মধুর। পুরো বাড়ি জুড়ে বর্মী (মিয়ানমার) চিত্রকলার বৈশিষ্টপূর্ণ অবস্থান। রয়েছে রঙ্গিন পাথরের কারুকার্যে ভরা পিলার।
তখন সকাল ৮ টা। কনকনে শীত। বিশ্বে রাজপ্রথা বিলুপ্ত হলেও রাজা ও রাজ্যের এ দেশে প্রথম পা দিয়েই বুঝে উঠতে আর বাকি ছিলনা গিরি ঝিরির শ্যামলিমায় রাজার মনমানসিকতা । এর একটু পরেই রাজা উ চ প্রু বোমাংগ্রীর সকালে সাক্ষাৎ । দারুণ লেগেছে রাজার সাথে কথা বলে। তিনি ১৬ তম বোমাং রাজা।
এবার তাঁর অনুমতি নিয়ে অন্দরমহলে ঘুরে দেখা। রাজবাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে ধীরে ধীরে পায়ে প্রদক্ষিণ আর ভাস্কর্যের আতিশয্য এবার মুগ্ধ হওয়ার পালা। রাজার চিরচারিত সিংহাসন,বিশাল আকারের তলোয়ার, রাজার মাথার মুকুট এবং সৈন্য সামান্তদের ব্যবহ্নত বল্লম,ছোরা,পোশাকসহ বিভিন্ন সামগ্রী রাজ বাড়ির প্রধান আকর্ষণ। অনন্য শিল্পসৃষ্টি, পাহাড়ের গায়ে ইট-সুরকির আধুনিক জগৎ, সে সঙ্গে বিস্ময়েরও। আধুনিক এ কারনে-সর্বাঙ্গ জুড়ে তার সমকালিন সমাজ জীবনের প্রকৃত চিত্র সোজাসুজি প্রকাশিত।
আরও বিস্ময়কর কারন, স্থাপত্য ও ভাস্কার্যের অনুপম সৌন্দর্য সেখানে হ্নদয় স্পর্শ করে ,আনন্দ দেয়। অন্দরমহল,প্রতিটি রুমে পাথরের সুক্ষ কারুকার্য আর অসামান্য শিল্পনৈপন্যের ছোঁয়া। রয়েছে নানা বুদ্ধ জীবনের পরবর্তী ঘটনা সমূহের খন্ডিত ভাস্কার্য। কোনটিতে পেখম খোলা ময়ূরের প্রতিমূর্তি । ১৮৮৮ সাল থেকে শত শত বছরের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন বোমাং রাজার পার্থিব সাত জীবনের নাটকীয় সব কাহিনী-বোমাং রাজার গল্প,আবার কোথাও বা বোমাং রাজার অলৌকিক ক্রিয়াধির ছবি। দ্বাররক্ষক ইত্যাদি নিপুণ দক্ষতার ইট-পাথরের গায়ে ফুটিয়ে তুলেছেন শত বছরের সে সব শিল্পীর দল, যা তাদের ভাবনা ও সৃষ্টিশীলতার জীবন্ত এক দলিল। চারদিকে গাছপালা,নিঝুম সজীবতা,কাঠের বেঞ্চে বসে ক্লান্ত পর্যটক আমার সহযাত্রী এলিন এ্যানি ও এন্ড্র লোপারসহ ওই রাজার ক্যামরায় চোখ রাখেন।
১৮৮৬ সালে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ অঞ্চলের মারমা অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে বোমাং সার্কেল গঠিত হয়। বান্দরবান পার্বত্য জেলায় এ সার্কেল খাজনা আদায় করেন। প্রায় ১৭৭৪ বর্গমাইল এলাকা ও ১০৯ টি মৌজা নিয়ে এ সার্কেলের আওতাভুক্ত।
উ চ প্রু বোমাংগ্রু বান্দরবান এলাকার বোমাংগ্রি (রাজা)। তিনি বোমাং সার্কেলের উত্তারাধিকারী হিসাবে ২০১৩ সালে রাজার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।১৭২৭ সাল থেকে বোমাং রাজার ইতিহাস শুরু। বিশ্বে রাজপ্রথা বিলুপ্ত হলেও এখানে রাজপ্রথা কালের সাক্ষী হিসাবে রয়েছে।
প্রতি বছর জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে এ বোমাং রাজার রাজ বাড়িতে রাজপুণ্যাহ মেলা বসে। মেলা চলে ৪ দিন। মেলা ঘিরে পাহাড়ি-বাঙ্গালীদের মিলন মেলায় পরিনত হয়। মেলায় যাত্রাপালা,পুতুল নাচ,নাগর দোলা,মৃত্যু কুপের বাই সাইকেল খেলা,সার্কাস ও বান্দরবান জেলায় বসবাসরত ১১ আধিবাসী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী মনোজ্ঞ সাস্কৃতিক বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে।
বান্দরবান পার্বত্য জেলার থানচি,রুমা ও সদর এলাকা ঘুরে সন্ধ্যায় আবার সেই রাজ বাড়িতে ফেরা। জোছনা রাতের আলোর ঝলকানি রাজ বাড়ির সুন্দর্য্যকে আরো বাড়িয়ে দেয় যত রাত বাড়ে। সময় থাকলে আপনিও উপভোগ করতে পারেন এই মহোময় সুন্দর্য ।
যাবেন কীভাবে :
চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দরহাট বাস টার্মিনাল থেকে বান্দরবানে যায় অসংখ্য বাস । এরমধ্যে পূরবী,সূরভী, এস আলম ,সৌদিয়াসহ বিভিন্ন সার্ভিসের বাস।
থাকবেন কোথায় :
বান্দরবান রাজবাড়িতে গেলে রাত যাপনের তেমন অসুবিধা হবেনা আপনার । বান্দরবান শহরে রয়েছে অসংখ্য থাকার হোটেল বা মোটেল। নানা রকম খাবার সামগ্রী নিয়ে রয়েছে রেস্টুরেন্ট সুবিধা। সেবার মান ও নিরাপত্তাসহ সকল ধরনের উন্নতমানের সুযোগ সুবিধা বিদ্যামান এ সব হোটেলে।