টার্গেট শিশুরা,নগরে বেড়েছে হত্যা, অপহরণ
পুলিশ বলছে নেপথ্যে সামাজিক অবক্ষয়
গেল ১৫ নভেম্বর নগরের ইপিজেড থানার বন্দরটিলার নয়ারহাট অফিস এলাকা থেকে নিখোঁজ হয় পাঁচ বছরের শিশু আয়াত। আর্জেন্টিনার জার্সি পরা আয়াতের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। তার খোঁজ চেয়ে থানায় জিডি করার পর পাশাপাশি এলাকায় পোস্টার ছাপায় তার পরিবার। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মুখে ১০ দিনের মাথায় তদন্তে উঠে আসে নিখোঁজ আয়াত হত্যার শিকার হয়েছেনা।
অপরহরণের পর আবীর আলী নামে এক যুবক ওই শিশুর পরিবারের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করেছিল। তবে সুবিধে করতে না পরে আয়াতকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এরপর বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আয়াতের মরদেহ ছয় টুকরো করে পানিতে ভাসিয়ে দেয়। এ ঘটনা রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি করে।
আয়াতের শোক কেটে না উঠতেই,গত ৮ ডিসেম্বর নগরের পাহাড়তলী থানার আমবাগান এলাকা থেকে প্রীতম দাশ নামে দশ বছরের এক শিশু নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দারস্থ হতে হয় পরিবারটিকে।
সর্বশেষ ১৭ ডিসেম্বর দুপুরে নগরের বায়োজিদ থানার রৌফাবাদ পাহাড়িকা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ফারজানা আক্তার নুপুর (১০) ।
ওই শিশুটির বাবা নুরুল আমিন জানান, তিন বছর আগে নুপুরের মা মারা গেছেন। কাজের কারণে তাকে বাইরে থাকতে হয়। নুপুরকে দেখভালের জন্য ফুফুর বাসায় রেখে যান। এরপর থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
নিখোঁজের বিষয়ে জানতে চাইলে বায়োজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফেরদৌস জাহান বলেন, শিশুটিকে উদ্ধারে পুলিশ কাজ করছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে আশারুনুপ ফল পাবো।
নুপুর নিখোঁজের খবরে আশঙ্কাজনক হারে অপরহরণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি সামনে এসেছ। প্রতিদিনই নিখোঁজের খবর গণমাধ্যম পাওয়া যাচ্ছে। কেবল নগরে নয় আড়াই মাস আগে বাঁশখালী ৯ নম্বর চনুয়া চেমটখালী এলাকা থেকে আতাউর রহমান নামে এক মাদ্রাসা ছাত্র নিখোঁজ হয়েছিল।
এদিকে শিশু নিখোঁজের খবরে অভিভাবকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে সিএমপি বলছে, এসব অপরহরণের পেছনে পারিবারিক ও জমি সংক্রান্ত বিরোধ, শত্রুতা,পরকীয়াসহ সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ থেকে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সন্তানদের দেখভালের বিষয়ে আরও সচেতন হওয়ার কথা বলছেন তারা।
তথ্য মতে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নগরে নারী ও শিশু অপরহরণের ঘটনায় থানায় ৪২টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এই সংখ্যার মধ্যে জানুয়ারিতে ৩টি, ফেব্রুয়ারীতে ২ টি, মার্চে ৮টি, এপ্রিলে ৪টি, মে মাসে ৬টি অভিযোগ আসে। এর মধ্যে জুনে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৮৫টি’তে। এর পর জুলাইয়ে ৭ টি, আগস্টে ২ টি, সেপ্টেম্বর অক্টোবরে ১টি করে অভিযোগ আসে। এদের অনেকেই বাসা থেকে খেলতে বের হয়ে, কেউবা স্কুলে যাওয়ার পর থেকে পাওয়া যায়নি।রয়েছে মুক্তিপণ আদায়ে ঘটনাও।
নগরের লালখান বাজার এলাকার বাসিন্দা নুরুল হক বলেন, কয়েক দিন ধরে নগরের বিভিন্ন এলাকায় শিশু নিখোঁজের খবর শুনতে পেয়েছি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাদের পাওয়া যায়। অনেককে খেলতে বের হওয়ার পর থেকে পাওয়া পাওয়া যায়নি। এমন সংবাদ শুনে অভিভাবক হিসেবে আমাদের আতঙ্কের কাজ করে। অনেকেই শিশুদের মাঠে খেলতে না পাঠিয়ে বাসার ছাদে খেলতে দিচ্ছে।
নুরজাহান নামে আরেক অভিভাবক বলেন, সারা দিন বাসায় থাকতে থাকতে শিশুরা হাফিয়ে উঠে। স্কুল ও টিউশনের পর বন্ধুদে সঙ্গে সময় কাটায়। সব সময় দেখভাল করে রাখা যায় না। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সোচ্চার হতে হবে।
তবে পারস্পরিক বিরোধের কারণে নিখোঁজের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানালেন সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) আ স ম মাহতাব উদ্দিন।
তিনি বলেন, এসব ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায় অনেকে জমিজমা ও পারস্পরিক বিরোধ, শত্রুতা, প্রতিশোধ,বাবা কিংবা মার পরকীয়ায় আসক্তি থেকেই শিশুরা অপহরণ কিংবা হত্যার শিকার হয়েছে, শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে এমন অভিযোগও আমাদের কাছে এসেছে। আমরা প্রতিটা ঘটনায় সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে তদন্ত করেছি। তবে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এর মাত্রা বেড়ে গেছে।
এক প্রশ্নে সিএমপির এই কর্মকর্তা বলেন, মুক্তিপণ চেয়ে শিশু অপরহরণের সংখ্যা খুবই নগন্য। আমি যোগদানের পর এমন একটি মাত্র ঘটনা পেয়েছি। সেটার তদন্ত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি উঠান বৈঠকে আমাদের পুলিশ সদস্যরা মাদক, শিশুদের দেখভাল, চুরি, ডাকাতি, পরকীয়া বিষয়কে সামনে রেখে কথা বলেন। আপনার ছেলে অবসর সময়ে কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে চলাফেরা করছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কী করছে, মাদককে আসক্তি হয়ে পড়ছে এসব বিষয়ে অভিভাবকদের দেখভাল করতে হবে। এসব আমাদের কাছে আসার আগে আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন। আশা করছি অভিভাবকরা সচেতন হলে অপরাধের মাত্রা কমে আসবে।
আরকে/জুইম/চখ