chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

চট্টগ্রামের সেই বঞ্চিত বীরের ত্যাগের মূল্যায়ন করলেন প্রধানমন্ত্রী

মনে প্রাণে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা। তৃণমূল থেকে দলকে সংগঠিত করতে গিয়ে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে জেল-জুলুমেও দলের প্রতি ভালোবাসার কমতি ছিল না। ছুটে গিয়েছেন নেতাকর্মীদের সুখ-দুঃখে। শপথ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত শেখ হাসিনার কাছ থেকে কিছু চাইবেন না।

তবে বার বার উপেক্ষিত হতে হয়েছে তাঁকে। শেষ সময়ে এসে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুছের ত্যাগের মূল্যায়ন করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দীর্ঘ পরীক্ষিত এই রাজনীতিককে আ. লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য করা হয়েছে।

গেল ১১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত এক দাওয়াত নামায় মো. ইউনুছকে জাতীয় কমিটির সদস্যের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। গত শনিবার তিনি গণভবনে জাতীয় কমিটির সভায় যোগ দেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দোয়া নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন।

জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ বলেন, আমাদের প্রাণ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ ক্ষমতাবলে আমাকে জাতীয় কমিটির সদস্য মনোনীত করেছেন। নেত্রীর দোয়া আমার চলার পথকে আরও সুংহত করবে।

জানা যায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ ১৯৫৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাটহাজারীর নুর আলী মিয়ার হাট ফরহাদাবাদ গ্রামের হিম্মত মুহুরী বাড়ির মরহুম নুর হোসেনের সন্তান। তাঁর বাবা ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক উচ্চতর হিসাব কর্মকর্তা।

তাঁর নামের পাশে জল জল করছে বর্ণিল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারেরর। ছাত্রলীগের স্কুল সভাপতি হয়ে হাতেখড়ি। এরপর নাম লেখান নগর সভাপতি পদে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় মাধ্যমিক স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৭০ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দু মেয়াদে নগর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দী অবস্থায় নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ছিলেন নগর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বে।

এরপর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি দু বার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। সাবেক ছাত্রলীগের এই নেতা ১৯৮৪ সালে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক হন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আ. লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য হন।

বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে ১৯৬৯ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ১৫ দিন কারাগারে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুছ। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বাতিলের আন্দোলনে যুক্ত থেকে পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে ৯ মাস সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯৭৬ সালে ‘বিশেষ সামরিক আদালত- ৪’ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলায় ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৮০ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দী ছিলেন। চার বছরের কারাজীবনে দু বছর কাটান কনডেম সেলে।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঐতিহাসিক লালদিঘীর ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় পাকিস্তানের পতাকা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন ইউনুছ। এর পরের দিন ৩ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে চট্টগ্রামের রাজপথে ঘুরেন।

২৭ মার্চ পাক নৌ-কমান্ডোর সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে প্রথম সংঘর্ষ হয় এবং রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। ২ মাস ৬ দিন ধরে শারীরিক নির্যাতনের মুখে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে ভারতে পালিয়ে যায়। ভারতের উত্তর প্রদেশ দেরাদুন তানদুয়ায় ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধের সামরিক প্রশিক্ষণ নেন তিনি। উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে সরাসরি অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে।

এদিকে জিয়াউর রহমানের সামরিক জান্তা আমলে ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে গিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে গোয়েন্দা সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপর তাঁকে ঢাকা সেনানিবাসে ৯ দিন, কুমিল্লা সেনানিবাসে ৩ দিন এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ১ মাস ২৮ দিন শারীরিক নির্যাতন শেষে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়।

১৯৮০ সালে কারাগার থেকে মুক্তির পর একাধিকবার দিল্লি যান। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি দিল্লির পানদার রোডের বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। এরপর দেশে ফিরে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ওই সময় সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন ডা. এসএ মালেক।

শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মী হিসেবে সব সময় সঙ্গে ছিলেন। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন যুবলীগ নেতা আবুল কাশেম মন্টু (সুত্রাপুর), ছাত্রনেতা হুমায়ন, জাহেদ। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে পরিকল্পিত আক্রমণের সময়ে সার্বক্ষণিক নেত্রীর পাশে ছিলেন।

বর্তমানে নগরের দক্ষিণ খুলশী আবাসিক এলাকার ১ নম্বর সড়কের ৬৯ নম্বর বাড়িতে বসবাস করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ। তিনি উত্তাল একাত্তরে চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চলের সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন। চট্টগ্রাম কারাগার থেকে বি. কম পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি ডিগ্রি পাস করেন।

তিনি একই সঙ্গে চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের মহাসচিব এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যোদ্ধা ফোরাম’৭৫-এর আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষা বোর্ড সদস্য, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলার আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী সমিতির আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম শহর সমাজসেবা প্রকল্প সমন্বয় পরিষদ-১ এর আজীবন সদস্য এবং পৌর জহুর হকার মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

 

আরকে/চখ

এই বিভাগের আরও খবর